জামাতে ইসলামীর রাজনীতি: গাজী আব্দুল কাদির মুকুল

- আপডেট সময় : ০১:০১:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪ ১১৮ বার পড়া হয়েছে
জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে দেশে এটি একটি অন্যতম বহত্তর রাজনৈতিক দল। একাত্তরে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে ছিল। সে অধিকার তাদের ছিল, কেননা তারা তখন পাকিস্তানি ছিল এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখা তাদের কেউ কেউ দেশপ্রেম বিবেচনা করেছিল। দেশপ্রেম প্রতিটি মানুষের চেতনাগত ও সহজাত আবেগ, যার মাধ্যমে তারা মাতৃভূমির প্রতি অতিমাত্রায় সংশ্লিষ্টতা অনভুব করে।
অন্যদিকে জামাতের রাজনীতিবিদরা মনে করেছিল, ভারত তাদের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে পৃষ্ঠপোষকতা ও নেতৃত্ব দিচ্ছে; অর্থাৎ বাংলাদেশকে সত্যিকার স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে তারা সহযোগিতা করছে না। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ভারতের আগ্রাসী আধিপত্যের নিশ্চিত আশঙ্কায় তারা মুক্তিযুদ্ধে শরিক হতে পারেনি। এছাড়াও তাদের বক্তব্য ছিল, তারা বা তাদের পূর্বপুরুষেরা সহ অখণ্ড ভারতের সকল মুসলিমগণ ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে। বিশেষ করে পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালীদের অবদান ভারতের অন্যান্য এলাকার মুসলমানদের চেয়ে অধিক ছিল।
বাঙালীদের অনেক রক্তদান ও সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণেই তৎকালীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পায়। অতএব, ১৯৭০ সালের
নির্বাচন পরবর্তী দেশে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়ে ছিল, সেটা নিরসনে লড়াই হবে দুর্বৃত্ত শাসকের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে নয়। দেশপ্রেমিকদের লক্ষ্য জালেম বা স্বৈরাচার শাসককে হটানো, দেশের বিনাশ নয়। তাই স্রেফ ক্ষমতা দখলের স্বার্থে দেশ ধ্বংস করা যেতে পারে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ব্রিটিশ শাসন থেকে পাকিস্তান মুসলিমলীগের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করার সময় অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। তবে, বাস্তবতা হলো স্বাধীনতার পর সবাই সেই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করেছেন, এবং স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য কাউকে শাস্তিভোগ করতে হয়নি। বিশ্বের কোন দেশেই এটি ঘটে না, কারণ স্বাধীনতার আগে থাকে রাজনৈতিক মতপার্থক্য আর স্বাধীনতার পরে সেটা দেশপ্রেম বা দেশদ্রোহিতার প্রশ্নে পরিণত হয়। এটা সব স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রেই সত্য। তবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে যারা যুদ্ধপরাধ করেছে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিল, তাদের বিচার হওয়া উচিত এবং দেশের বেশিরভাগ মানুষই তা চায়। এটি বিশ্বের সব দেশেই ঘটে। কিন্তু বিচারের নামে বিচার প্রক্রিয়ায় কোন দুরভিসন্ধি, রাজনৈতিক অসাধুতা, প্রতিহিংসা বা বিরোধী মতাবলম্বীদের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো কাম্য নয়। একই সাথে, প্রকৃত অপরাধীদের রাজনৈতিক
স্বার্থে রক্ষা করা, অভিযুক্ত না করা, সেটাও এক ধরনের অপরাধ।
দুঃখজনক হলে ও সত্য যে, বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার যুদ্ধাপরাধের নামে এক প্রহসনমূলক নাটক মঞ্চস্থ করেছেন এবং শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কয়েকজন জামাত ও বিএনপি নেতাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রমাণ ছাড়াই অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ফাঁসির নামে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘৃণিত বিচার প্রক্রিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরকাল সাক্ষী হয়ে থাকবে।
যাইহোক, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করাটা জামাতে ইসলামির জন্য ভুল ছিল এবং চূড়ান্ত ফলাফল দেখে তারা সে প্রমাণ পেয়েছে। তবে এটা সত্য যে, স্বাধীনতার পরে তারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে চলেছে। সেই হিসাবে এ দেশের রাজনীতি করার অধিকার তাদের আছে। তাই নানারূপ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দলটি আইনত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অবশ্যই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিহিংসার কারণে স্বভাবতই জামাতের শত্রুপক্ষ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সংগঠনটি ইসলাম বিরোধীদের চোখে পড়ে এবং বিরোধী পক্ষ ও স্বার্থান্বেষী মহল অব্যাহতভাবে জামাতের বিরুদ্ধে বহুবিধ ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারে লিপ্ত। তবে বিভিন্ন সময় জনগণ কর্তৃক জামাতে ইসলামের এমপি ও মন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশের খেদমত করে চলেছে।
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে, খুঁজে পাবেন যে বিভিন্ন সময়ে জামাতে ইসলামী- আওয়ামীলীগ ও বিএনপির সাথে জুটবদ্ধতার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা উপভোগ করেছে। এছাড়াও ৯০-এর গণআন্দোলনের মাধ্যমে যে এরশাদ সরকার ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হয়েছিল; তা বিএনপি, আওয়ামীলীগ ও জামাতে ইসলামের একসাথে আন্দোলন করার কারণে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনের পর এককভাবে বিএনপির পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব না
হওয়ায়, তারা জামাতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তি তে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে এবং জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে জামাতের সদস্য দেওয়া হয়। কিছুসময় পরে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ক বিরোধে বিএনপির সঙ্গে জামাতের মতবিরোধ দেখা দেয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামাতে ইসলামী একত্রে গলাগলি করে দেশব্যাপী গণআন্দোলন শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা সম্মিলিতভাবে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। এক পর্যায়ে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেনে নেয়।
উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী অভিযানের আগে, আওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা জামাতে ইসলামী আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে গিয়ে দোয়া ও আশীর্বাদ লাভ করেন ।
হাসিনা সরকারের সময়, ১৯৯৯ সালে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্য জোটের মাধ্যমে একটি চারদলীয় জোট গঠিত হয় এবং স্বৈরাচারী ও দুর্নীতি পরায়ণ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে একসঙ্গে আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তীতে, ২০০১ সালের নির্বাচনে জামাতে ইসলামীকে সহযোগী হিসেবে নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে এবং তাদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে স্থান দেওয়া ছাড়াও মন্ত্রি পরিষদে কয়েকজনকে সদস্য করা হয়। এতদসত্ত্বেও, বর্তমানকালে আওয়ামীলীগ এবং তাদের ইসলাম বিরোধী তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা হরহামেশাই বলে আসছেন যে জামাত মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি এবং স্বাধীনতার চেতনার বিরোধী। অথচ জনগণ চায় না যে স্বাধীনতার ৫৫ বছর পরে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের নামে দেশকে বিভক্ত ও দুর্বল করে রাখা হোক। তাই নির্বাচনে জামাতের অনেক সংসদ সদস্যকে ভোট দিয়ে জনগণ জানিয়ে দিয়েছে যে তারাই জনগণের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য।
বলাবাহুল্য, জামাতে ইসলামী সম্পর্কে এগুলো কোনো বানানো কথা নয়; এসব হলো অকাট্য ঐতিহাসিক সত্য। এই সত্যগুলো আড়াল, গোপন বা অস্বীকার করা উচিত নয়।
পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জামাতে ইসলামের রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই বা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যও নই। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে জামাতের সব বিষয়ে একমতও নই। তবে,মতভেদ থাকা সত্ত্বেও বাস্তবতা বা সত্য উপলব্ধি ও বিবেকের দায়বদ্ধতা আমাকে জামাতে ইসলামের বিষয়ে কিছুকথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনভুব করিয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী