ঢাকা ০২:২৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
খুলনার সাবেক এমপি রশীদুজ্জামান মোড়ল গ্রেপ্তার বিয়ানীবাজার থানার এসআই আসাদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রবাসীর স্ত্রীর অভিযোগ মধ্যরাতে হঠাৎ উত্তপ্ত রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়; সড়ক অবরোধ, বখাটে দু’জন আটক সিলেট উইমেনস জার্নালিস্ট ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদকের বাবার মৃত্যু, শোক প্রকাশ নেতাকর্মীদের সিলেট জেলা ও মহানগর যুবদলের সতকর্তা সিলেট বোর্ডে পাসের হার ৮৫.৩৯, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৬৯৮ জন সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে সিলেটে বিক্ষোভ মিছিল সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর তৌফিক বক্স গ্রেপ্তার জামাতে ইসলামীর রাজনীতি: গাজী আব্দুল কাদির মুকুল সরকারি চাকরিতে পুরুষের ক্ষেত্রে ৩৫ ও নারীর ক্ষেত্রে ৩৭ বছর করার সুপারিশ

যে কথা যায় না বলা শুধু বুঝা যায়

গাজী আব্দুল কাদির মুকুল
  • আপডেট সময় : ১২:৫২:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৬২ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর চেতনার ফেরিওয়ালারা ঘৃণ্য মিথ্যাচারীতায় সর্বদা লিপ্ত থাকে। সত্যকে হত্যা করে, বানোয়াট চেতনার কথা রটনা করে দেশের মানুষকে মিথ্যার উপাসক, প্রচারক ও সৈনিক হিসেবে পরিণত করার ক্রমাগত ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। কথায় কথায় চেতনার কথা বলে মুখে ফেনা তুলে, একটু বাড়তি উত্তেজনায় থাকেন। তাদের আসল পুঁজি হচ্ছে সব সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা। হরদম এসব মিথ্যা চেতনার কথা শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষের কান জ্বালা করে। বিশেষ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জনবিচ্ছিন্ন বামপন্থীদের পক্ষ থেকে দেশের কমলমতি শিশু-কিশোরদের মগজ ধোলাই করা হয়। তাদেরকে বলা হয় না, মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পত্রে কী চেতনা ছিল। বস্তুত, ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মেহেরপুরের আমবাগানে গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার। সেই সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রের নীতির ভিত্তিতেই মুক্তিযুদ্ধ করেছে বাংলাদেশের মানুষ। তখন সবার সামনে ছিল এই ঘোষণা পত্রে ঘোষিত চেতনার বিষয়গুলো। এই ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলনীতি ছিল তিনটি। তিন মূলনীতির মধ্যে ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ও সামাজিক ন্যায়বিচার। মূলনীতির কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিল না এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিষয়টিও উল্লেখিত ছিল না। এছাড়াও, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণ মুক্তি এবং শাসনের প্রকারণ আচরণ। সুতরাং, ধর্মনিরপেক্ষতা স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার দাবি-এ কথা সত্যের অপপ্রলাপ বৈ আর কিছু নয়। অন্যদিকে স্বাধীনতা পূর্বকালে কোনো দল ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেনি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ‘৬৯-এর ১১ দফা ও গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনকালেও কোনো দল ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেনি।

সংবিধান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তাচেতনা, ঈমান আকিদার রূপায়ন এবং অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি। কিন্তু ৭২-এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সংযোজনের ফলে তাদের আশা-আকাঙক্ষা এবং স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনার প্রতিফলন হয়নি। বরং, বিশেষ মহলের স্বার্থরক্ষার জন্য এটা করা হয়েছিল। বুদ্ধিবৃত্তিক সিন্ডিকেট করে সুদূরপ্রসারী অভিপ্রায়ে বাংলাদেশের আদর্শিক মূল শিকড় কেটে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তির কারণেই ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র তুলে দিয়ে সংবিধানে মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করা হয় এবং জনগণের অনুভূতির কথা বিবেচনা করে অনেক ধর্মীয় মূল্যবোধকেও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে আনা হয়। এতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাবাদর্শের প্রতিধ্বনি ঘটেছে। কিন্তু ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী একটি চক্র তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন রকম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আসছে এবং এখনও ছড়িয়ে যাচ্ছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার জিগির তুলে গণমানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে এবং নির্লজ্জতার পরিচয় দিচ্ছে।

যাই হোক, পরবর্তীতে আসল চেতনা কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান চেতনায় রূপ নিয়েছে সেই ইতিহাস বিকৃতির প্রসঙ্গ কেউ খণ্ডন করে তথ্য প্রমাণ হাজির করলে আওয়ামী লীগ ও তথাকথিত জনবিচ্ছিন্ন বামপন্থীরা রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধী, সম্প্রদায়িক বা মৌলবাদী বলে গালি দেয়। পরিতাপের বিষয়, ঐতিহাসিক সত্য আবিষ্কারের ব্যর্থতার কারণেই সেই উদ্ভট মিথ্যার ন্যায় অসংখ্য মিথ্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রবলভাবে বেঁচে আছে। এরূপ নিরেট মিথ্যা বহু লক্ষ প্রচারকও পেয়েছে।

জামাতে ইসলামের রাজনীতি: জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে
দেশে এটি একটি অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক দল। একাত্তরে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। সে অধিকার তাদের ছিল, কেননা তারা তখন পাকিস্তানি ছিল এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখা তাদের কেউ কেউ দেশপ্রেম বিবেচনা করেছিল। দেশপ্রেম প্রতিটি মানুষের চেতনাগত ও সহজাত আবেগ, যার মাধ্যমে তারা মাতৃভূমির প্রতি অতিমাত্রায় সংশ্লিষ্টতা অনুভব করে। অন্যদিকে জামাতের রাজনীতিবিদরা মনে করেছিল, ভারত তাদের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে পৃষ্ঠপোষকতা ও নেতৃত্ব দিচ্ছে; অর্থাৎ বাংলাদেশকে সত্যিকার স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে তারা সহযোগিতা করছে না। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ভারতের আগ্রাসী আধিপত্যের নিশ্চিত আশঙ্কায় তারা মুক্তিযুদ্ধে শরিক হতে পারে নি। এছাড়াও তাদের বক্তব্য ছিল, তারা বা তাদের পূর্বপুরুষেরা, সহ অখণ্ড ভারতের সকল মুসলিমগণ ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে। বিশেষ করে পাকিস্তানের সৃষ্টিতে বাঙালীদের অবদানটি ছিল ভারতের অন্যান্য এলাকার মুসলমানদের চেয়ে অধিক। বাঙালীদের অনেক রক্তদান ও সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণেই তৎকালীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পায়। অতএব, ১৯৭০ সালের নির্বাচন পরবর্তী দেশে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা নিরসনে লড়াই হবে দুর্বৃত্ত শাসকের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে নয়। দেশপ্রেমিকদের লক্ষ্য জালেম বা স্বৈরাচার শাসককে হটানো, দেশের বিনাশ নয়। তাই স্রেফ ক্ষমতা দখলের স্বার্থে দেশ ধ্বংস করা যেতে পারে না।

যাইহোক, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করাটা জামাতে ইসলামের জন্য ভুল ছিল এবং চূড়ান্ত ফলাফল দেখে তারা সে প্রমাণ পেয়েছে। তবে একতা সত্য যে, স্বাধীনতার পরে তারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে চলেছে। সেই হিসাবে এ দেশের রাজনীতি করার অধিকার তাদের আছে। তাই নানারূপ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দলটি আইনত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অবশ্যই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও অপ্রতিহিংসার কারণে স্বভাবতই জামাতের শত্রুপক্ষ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সংগঠনটি ইসলামবিরোধীদের চোখে পড়ে এবং বিরোধী পক্ষ ও স্বার্থন্বেষী মহল অব্যাহতভাবে জামাতের বিরুদ্ধে বহুবিধ ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারে লিপ্ত।

বিভিন্ন সময় জনগণ কর্তৃক জামাতে ইসলামের এমপি ও মন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশের খেদমত করে চলেছে। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে, খুঁজে পাবেন যে বিভিন্ন সময়ে জামাতে ইসলামী- আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাথে জুটবদ্ধতার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা উপভোগ করেছে। এছাড়াও ৯০-এর গণ আন্দোলনের মাধ্যমে যে এরশাদ সরকার ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হয়েছিল; তা বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামাতে ইসলামের একসাথে আন্দোলন করার কারণে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনের পর এককভাবে বিএনপির পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব না হওয়ায়, তারা জামাতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে এবং জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে জামাতের সদস্য দেওয়া হয়। কিছু সময় পরে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ক বিরোধে বিএনপির সঙ্গে জামাতের মতবিরোধ দেখা দেয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পাটি এবং জামাতে ইসলামী একত্রে দেশব্যাপী গণআন্দোলন শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা সম্মিলিতভাবে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। একপর্যায়ে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেনে নেয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী অভিযানের আগে, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা জামাতে ইসলামী আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে গিয়ে দোয়া ও আশীর্বাদ লাভ করেন।

হাসিনা সরকারের সময়, ১৯৯৯ সালে বিএনপি, জাতীয় পাটি, জামাতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্য জোটের মাধ্যমে একটি চারদলীয় জোট গঠিত হয় এবং স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে একসঙ্গে আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তীতে, ২০০১ সালের নির্বাচনে জামাতে ইসলামীকে সহযোগী হিসেবে নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে এবং তাদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে স্থান দেওয়া ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদে কয়েকজনকে সদস্য করা হয়। বলাবাহুল্য, জামাতে ইসলামী সম্পর্কে এগুলো কোনো বানানো কথা নয়; এসব হলো অকাট্য ঐতিহাসিক সত্য। এই সত্যগুলো আড়াল, গোপন বা অস্বীকার করা উচিত নয়।

পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জামাতে ইসলামের রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই বা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যও নই। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে জামাতের সব বিষয়ে একমতও নই। তবে, মতভেদ থাকা সত্ত্বেও বাস্তবতা বা সত্য উপলব্ধি ও বিবেকের দায়বদ্ধতা আমাকে জামাতে ইসলামের বিষয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়েছে।

শেখ মুজিবের শাসন আমল:
স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামীলীগ ভুল পথে পা দিয়েছিলো। আওয়ামীলীগ একলা মুক্তিযুদ্ধ করেনি। সকল দল ও মতের এবং নির্দলীয় মানুষ ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করেছিলো বলেই স্বাধীনতা এতো তাড়াতাড়ি এসেছিলো। যুদ্ধের সময় আওয়ামীলীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান রণাঙ্গনে হাজিরও ছিলেননা। আপসে ধরা দিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ধারণা তাঁর মাথায় প্রথম আসেনি। তাঁর অনেক আগে থেকেই মওলানা ভাসানী ও অন্যান্যরা জাতিকে স্বাধীনতার জন্যে প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলেন। মুজিবের অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।

যুদ্ধ করেছিলো দল-মত-গোষ্ঠি-নির্বিশেষে সকলেই, কিন্তু গোড়া থেকেই সর্বময় ক্ষমতা গ্রাস করে নিয়েছিলো আওয়ামীলীগ। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সহ কেউ কেউ আওয়ামী লীগের একচেটিয়া ক্ষমতা গ্রাসের বিরোধিতা করে। তাদের নিধন করার জন্যে রক্ষী বাহিনী নামে একটা ঘাতক বাহিনী গঠন করা হয়। এরা চল্লিশ হাজার লোককে হত্যা করেছিলো। ভিন্ন চেহারায় হলেও সে প্রক্রিয়া আরো বহুগুণ বেশি শেখ হাসিনার আমলেও চলেছিল। বস্তুতঃ এটাই ছিলো আওয়ামী আমলে বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা।

শেখ পরিবার বাংলাদেশকে পারিবারিক সম্পত্তি বিবেচনা করে। শেখ মুজিব দেশে ফিরে নিজেই ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনিও জাসদকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চেয়েছিলেন, বলেছিলেন: ‘লাল ঘোড়া দাবাইয়া দিব’। সর্বহারা পার্টি নেতা সিরাজ শিকদারকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এতোসব করেও আওয়ামীলীগের ক্ষমতার ক্ষুধা মেটেনি। পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্যে একদলীয় শাসন পাকাপোক্ত করার জন্যে মধ্য মেয়াদে সংসদের নির্বাচন দেওয়া হয়। অথচ তখন নির্বাচনী দলাদলি ও বিভাজনের পরিবর্তে প্রয়োজন ছিলো জাতীয় ঐক্য গঠন করে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করার। সে নির্বাচন ছিলো খুবই বিভাজক। অন্ততঃ চারটি আসন আওয়ামীলীগ বলপূর্বক অসাধু উপায়ে জয় করেছিলো। শেখ মুজিবের অন্যতম রাজনৈতিক গুরু আতাউর রহমান খান দলনিরপেক্ষ প্রার্থী হিসেবে ধামরাই কেন্দ্রে প্রার্থী দাঁড়িয়েছিলেন বলে আওয়ামীলীগের কর্মীরা তাঁকে ছিনতাই করে আটক রাখে।

শেখ মুজিবের প্রশাসনিক যোগ্যতা ছিলোনা। তিনি কতিপয় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির হাতের মুঠোয় চলে যান, যাঁরা সকলে স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেননা। শেখ মুজিবকে ফুলের মালা আর স্তব-স্তৃতি দিয়ে ভুলিয়ে রেখে তাঁরা বেপরোয়া দুর্ণীতি আর লুটপাট করেছেন। দুর্ণীতি ক্রমে ক্রমে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে, এমনকি শেখ মুজিবের পরিবারেও ঢুকে পড়ে বলে তখন বলাবলি হতো। এ সবের ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছিলো। দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় কিন্তু খাদ্য আমদানীর অর্থ ছিলোনা রাষ্ট্রীয় তহবিলে। সত্তর হাজার লোক মারা গিয়েছিলো সে দুর্ভিক্ষে। সামাজিক ভাবে এবং জাতীয় পত্রপত্রিকায় সমালোচনা শুরু হলে মুজিব জরুরী ক্ষমতা আইন পাশ করে হাজার হাজার লোককে কয়েদ করেন এবং চারখানি সরকারী পত্রিকা ছাড়া অন্য সকল পত্র-পত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেন। মুজিবকে শিখণ্ডি করে যারা দিবারাত্রি পুকুর চুরির মতো দুর্নীতি করে যাচ্ছিলো তারা তাঁকে আজীবন রাষ্ট্রপতি হবার ইন্ধন জোগায়। একাত্তরে বাংলাদেশের সকল মানুষ জানতো তারা গণতন্ত্রের জন্যে যুদ্ধ করছে, কিন্তু মুজিব গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি চালু করেন, আওয়ামীলীগ সহ সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন এবং নিজে প্রথম দফায় সাত বছরের জন্যে রাষ্ট্রপতি হন। বাকশাল চালু হবার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাগুলো অনিবার্য্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। অন্ততঃ সেদিনের ঘটনায় বাংলাদেশে কেউ চোখের পানি ফেলেনি। আওয়ামীলীগের একদলীয় শাসন এবং শেখ মুজিবের সম্রাট-সুলভ একনায়কত্বের যে রীতি ১৯৭২ সালের জানুয়ারী থেকেই চালু হয়েছিলো আওয়ামীলীগ কখনোই সে মনোভাব পরিত্যাগ করতে পারেনি।

লেখক: প্রাবন্ধিক

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

যে কথা যায় না বলা শুধু বুঝা যায়

আপডেট সময় : ১২:৫২:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর চেতনার ফেরিওয়ালারা ঘৃণ্য মিথ্যাচারীতায় সর্বদা লিপ্ত থাকে। সত্যকে হত্যা করে, বানোয়াট চেতনার কথা রটনা করে দেশের মানুষকে মিথ্যার উপাসক, প্রচারক ও সৈনিক হিসেবে পরিণত করার ক্রমাগত ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। কথায় কথায় চেতনার কথা বলে মুখে ফেনা তুলে, একটু বাড়তি উত্তেজনায় থাকেন। তাদের আসল পুঁজি হচ্ছে সব সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা। হরদম এসব মিথ্যা চেতনার কথা শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষের কান জ্বালা করে। বিশেষ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জনবিচ্ছিন্ন বামপন্থীদের পক্ষ থেকে দেশের কমলমতি শিশু-কিশোরদের মগজ ধোলাই করা হয়। তাদেরকে বলা হয় না, মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পত্রে কী চেতনা ছিল। বস্তুত, ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মেহেরপুরের আমবাগানে গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার। সেই সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রের নীতির ভিত্তিতেই মুক্তিযুদ্ধ করেছে বাংলাদেশের মানুষ। তখন সবার সামনে ছিল এই ঘোষণা পত্রে ঘোষিত চেতনার বিষয়গুলো। এই ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলনীতি ছিল তিনটি। তিন মূলনীতির মধ্যে ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ও সামাজিক ন্যায়বিচার। মূলনীতির কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিল না এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিষয়টিও উল্লেখিত ছিল না। এছাড়াও, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণ মুক্তি এবং শাসনের প্রকারণ আচরণ। সুতরাং, ধর্মনিরপেক্ষতা স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার দাবি-এ কথা সত্যের অপপ্রলাপ বৈ আর কিছু নয়। অন্যদিকে স্বাধীনতা পূর্বকালে কোনো দল ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেনি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ‘৬৯-এর ১১ দফা ও গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনকালেও কোনো দল ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেনি।

সংবিধান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তাচেতনা, ঈমান আকিদার রূপায়ন এবং অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি। কিন্তু ৭২-এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সংযোজনের ফলে তাদের আশা-আকাঙক্ষা এবং স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনার প্রতিফলন হয়নি। বরং, বিশেষ মহলের স্বার্থরক্ষার জন্য এটা করা হয়েছিল। বুদ্ধিবৃত্তিক সিন্ডিকেট করে সুদূরপ্রসারী অভিপ্রায়ে বাংলাদেশের আদর্শিক মূল শিকড় কেটে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তির কারণেই ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র তুলে দিয়ে সংবিধানে মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করা হয় এবং জনগণের অনুভূতির কথা বিবেচনা করে অনেক ধর্মীয় মূল্যবোধকেও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে আনা হয়। এতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাবাদর্শের প্রতিধ্বনি ঘটেছে। কিন্তু ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী একটি চক্র তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন রকম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আসছে এবং এখনও ছড়িয়ে যাচ্ছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার জিগির তুলে গণমানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে এবং নির্লজ্জতার পরিচয় দিচ্ছে।

যাই হোক, পরবর্তীতে আসল চেতনা কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান চেতনায় রূপ নিয়েছে সেই ইতিহাস বিকৃতির প্রসঙ্গ কেউ খণ্ডন করে তথ্য প্রমাণ হাজির করলে আওয়ামী লীগ ও তথাকথিত জনবিচ্ছিন্ন বামপন্থীরা রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধী, সম্প্রদায়িক বা মৌলবাদী বলে গালি দেয়। পরিতাপের বিষয়, ঐতিহাসিক সত্য আবিষ্কারের ব্যর্থতার কারণেই সেই উদ্ভট মিথ্যার ন্যায় অসংখ্য মিথ্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রবলভাবে বেঁচে আছে। এরূপ নিরেট মিথ্যা বহু লক্ষ প্রচারকও পেয়েছে।

জামাতে ইসলামের রাজনীতি: জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে
দেশে এটি একটি অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক দল। একাত্তরে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। সে অধিকার তাদের ছিল, কেননা তারা তখন পাকিস্তানি ছিল এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখা তাদের কেউ কেউ দেশপ্রেম বিবেচনা করেছিল। দেশপ্রেম প্রতিটি মানুষের চেতনাগত ও সহজাত আবেগ, যার মাধ্যমে তারা মাতৃভূমির প্রতি অতিমাত্রায় সংশ্লিষ্টতা অনুভব করে। অন্যদিকে জামাতের রাজনীতিবিদরা মনে করেছিল, ভারত তাদের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে পৃষ্ঠপোষকতা ও নেতৃত্ব দিচ্ছে; অর্থাৎ বাংলাদেশকে সত্যিকার স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে তারা সহযোগিতা করছে না। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ভারতের আগ্রাসী আধিপত্যের নিশ্চিত আশঙ্কায় তারা মুক্তিযুদ্ধে শরিক হতে পারে নি। এছাড়াও তাদের বক্তব্য ছিল, তারা বা তাদের পূর্বপুরুষেরা, সহ অখণ্ড ভারতের সকল মুসলিমগণ ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে। বিশেষ করে পাকিস্তানের সৃষ্টিতে বাঙালীদের অবদানটি ছিল ভারতের অন্যান্য এলাকার মুসলমানদের চেয়ে অধিক। বাঙালীদের অনেক রক্তদান ও সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণেই তৎকালীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পায়। অতএব, ১৯৭০ সালের নির্বাচন পরবর্তী দেশে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা নিরসনে লড়াই হবে দুর্বৃত্ত শাসকের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে নয়। দেশপ্রেমিকদের লক্ষ্য জালেম বা স্বৈরাচার শাসককে হটানো, দেশের বিনাশ নয়। তাই স্রেফ ক্ষমতা দখলের স্বার্থে দেশ ধ্বংস করা যেতে পারে না।

যাইহোক, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করাটা জামাতে ইসলামের জন্য ভুল ছিল এবং চূড়ান্ত ফলাফল দেখে তারা সে প্রমাণ পেয়েছে। তবে একতা সত্য যে, স্বাধীনতার পরে তারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে চলেছে। সেই হিসাবে এ দেশের রাজনীতি করার অধিকার তাদের আছে। তাই নানারূপ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দলটি আইনত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অবশ্যই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও অপ্রতিহিংসার কারণে স্বভাবতই জামাতের শত্রুপক্ষ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সংগঠনটি ইসলামবিরোধীদের চোখে পড়ে এবং বিরোধী পক্ষ ও স্বার্থন্বেষী মহল অব্যাহতভাবে জামাতের বিরুদ্ধে বহুবিধ ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারে লিপ্ত।

বিভিন্ন সময় জনগণ কর্তৃক জামাতে ইসলামের এমপি ও মন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশের খেদমত করে চলেছে। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে, খুঁজে পাবেন যে বিভিন্ন সময়ে জামাতে ইসলামী- আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাথে জুটবদ্ধতার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা উপভোগ করেছে। এছাড়াও ৯০-এর গণ আন্দোলনের মাধ্যমে যে এরশাদ সরকার ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হয়েছিল; তা বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামাতে ইসলামের একসাথে আন্দোলন করার কারণে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনের পর এককভাবে বিএনপির পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব না হওয়ায়, তারা জামাতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে এবং জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে জামাতের সদস্য দেওয়া হয়। কিছু সময় পরে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ক বিরোধে বিএনপির সঙ্গে জামাতের মতবিরোধ দেখা দেয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পাটি এবং জামাতে ইসলামী একত্রে দেশব্যাপী গণআন্দোলন শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা সম্মিলিতভাবে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। একপর্যায়ে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেনে নেয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী অভিযানের আগে, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা জামাতে ইসলামী আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে গিয়ে দোয়া ও আশীর্বাদ লাভ করেন।

হাসিনা সরকারের সময়, ১৯৯৯ সালে বিএনপি, জাতীয় পাটি, জামাতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্য জোটের মাধ্যমে একটি চারদলীয় জোট গঠিত হয় এবং স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে একসঙ্গে আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তীতে, ২০০১ সালের নির্বাচনে জামাতে ইসলামীকে সহযোগী হিসেবে নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে এবং তাদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে স্থান দেওয়া ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদে কয়েকজনকে সদস্য করা হয়। বলাবাহুল্য, জামাতে ইসলামী সম্পর্কে এগুলো কোনো বানানো কথা নয়; এসব হলো অকাট্য ঐতিহাসিক সত্য। এই সত্যগুলো আড়াল, গোপন বা অস্বীকার করা উচিত নয়।

পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জামাতে ইসলামের রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই বা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যও নই। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে জামাতের সব বিষয়ে একমতও নই। তবে, মতভেদ থাকা সত্ত্বেও বাস্তবতা বা সত্য উপলব্ধি ও বিবেকের দায়বদ্ধতা আমাকে জামাতে ইসলামের বিষয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়েছে।

শেখ মুজিবের শাসন আমল:
স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামীলীগ ভুল পথে পা দিয়েছিলো। আওয়ামীলীগ একলা মুক্তিযুদ্ধ করেনি। সকল দল ও মতের এবং নির্দলীয় মানুষ ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করেছিলো বলেই স্বাধীনতা এতো তাড়াতাড়ি এসেছিলো। যুদ্ধের সময় আওয়ামীলীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান রণাঙ্গনে হাজিরও ছিলেননা। আপসে ধরা দিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ধারণা তাঁর মাথায় প্রথম আসেনি। তাঁর অনেক আগে থেকেই মওলানা ভাসানী ও অন্যান্যরা জাতিকে স্বাধীনতার জন্যে প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলেন। মুজিবের অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।

যুদ্ধ করেছিলো দল-মত-গোষ্ঠি-নির্বিশেষে সকলেই, কিন্তু গোড়া থেকেই সর্বময় ক্ষমতা গ্রাস করে নিয়েছিলো আওয়ামীলীগ। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সহ কেউ কেউ আওয়ামী লীগের একচেটিয়া ক্ষমতা গ্রাসের বিরোধিতা করে। তাদের নিধন করার জন্যে রক্ষী বাহিনী নামে একটা ঘাতক বাহিনী গঠন করা হয়। এরা চল্লিশ হাজার লোককে হত্যা করেছিলো। ভিন্ন চেহারায় হলেও সে প্রক্রিয়া আরো বহুগুণ বেশি শেখ হাসিনার আমলেও চলেছিল। বস্তুতঃ এটাই ছিলো আওয়ামী আমলে বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা।

শেখ পরিবার বাংলাদেশকে পারিবারিক সম্পত্তি বিবেচনা করে। শেখ মুজিব দেশে ফিরে নিজেই ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনিও জাসদকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চেয়েছিলেন, বলেছিলেন: ‘লাল ঘোড়া দাবাইয়া দিব’। সর্বহারা পার্টি নেতা সিরাজ শিকদারকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এতোসব করেও আওয়ামীলীগের ক্ষমতার ক্ষুধা মেটেনি। পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্যে একদলীয় শাসন পাকাপোক্ত করার জন্যে মধ্য মেয়াদে সংসদের নির্বাচন দেওয়া হয়। অথচ তখন নির্বাচনী দলাদলি ও বিভাজনের পরিবর্তে প্রয়োজন ছিলো জাতীয় ঐক্য গঠন করে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করার। সে নির্বাচন ছিলো খুবই বিভাজক। অন্ততঃ চারটি আসন আওয়ামীলীগ বলপূর্বক অসাধু উপায়ে জয় করেছিলো। শেখ মুজিবের অন্যতম রাজনৈতিক গুরু আতাউর রহমান খান দলনিরপেক্ষ প্রার্থী হিসেবে ধামরাই কেন্দ্রে প্রার্থী দাঁড়িয়েছিলেন বলে আওয়ামীলীগের কর্মীরা তাঁকে ছিনতাই করে আটক রাখে।

শেখ মুজিবের প্রশাসনিক যোগ্যতা ছিলোনা। তিনি কতিপয় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির হাতের মুঠোয় চলে যান, যাঁরা সকলে স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেননা। শেখ মুজিবকে ফুলের মালা আর স্তব-স্তৃতি দিয়ে ভুলিয়ে রেখে তাঁরা বেপরোয়া দুর্ণীতি আর লুটপাট করেছেন। দুর্ণীতি ক্রমে ক্রমে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে, এমনকি শেখ মুজিবের পরিবারেও ঢুকে পড়ে বলে তখন বলাবলি হতো। এ সবের ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছিলো। দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় কিন্তু খাদ্য আমদানীর অর্থ ছিলোনা রাষ্ট্রীয় তহবিলে। সত্তর হাজার লোক মারা গিয়েছিলো সে দুর্ভিক্ষে। সামাজিক ভাবে এবং জাতীয় পত্রপত্রিকায় সমালোচনা শুরু হলে মুজিব জরুরী ক্ষমতা আইন পাশ করে হাজার হাজার লোককে কয়েদ করেন এবং চারখানি সরকারী পত্রিকা ছাড়া অন্য সকল পত্র-পত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেন। মুজিবকে শিখণ্ডি করে যারা দিবারাত্রি পুকুর চুরির মতো দুর্নীতি করে যাচ্ছিলো তারা তাঁকে আজীবন রাষ্ট্রপতি হবার ইন্ধন জোগায়। একাত্তরে বাংলাদেশের সকল মানুষ জানতো তারা গণতন্ত্রের জন্যে যুদ্ধ করছে, কিন্তু মুজিব গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি চালু করেন, আওয়ামীলীগ সহ সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন এবং নিজে প্রথম দফায় সাত বছরের জন্যে রাষ্ট্রপতি হন। বাকশাল চালু হবার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাগুলো অনিবার্য্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। অন্ততঃ সেদিনের ঘটনায় বাংলাদেশে কেউ চোখের পানি ফেলেনি। আওয়ামীলীগের একদলীয় শাসন এবং শেখ মুজিবের সম্রাট-সুলভ একনায়কত্বের যে রীতি ১৯৭২ সালের জানুয়ারী থেকেই চালু হয়েছিলো আওয়ামীলীগ কখনোই সে মনোভাব পরিত্যাগ করতে পারেনি।

লেখক: প্রাবন্ধিক