ঢাকা ০৮:২৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
কোতোয়ালী মডেল থানা পুলিশের অভিযানে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে দেশীয় অস্ত্রসহ ০৬ (ছয়) ডাকাত গ্রেফতারঃ আপনাদের ক্ষতির পরিমাণ অপূরনীয় : ইমদাদ চৌধুরী ওসমানীনগরে দলিল লেখক আখতার আহমদকে নিয়ে তোলপাড়! গণঅধিকার পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের মতবিনিময় বিসিবি কর্মকর্তা ইকরাম চৌধুরীর মৃত্যুতে ইমদাদ চৌধুরীর শোক প্রকাশ এবার সিলেটে ট্রাক চাপায় মারা গেলেন এক যুবক ! সিলেট মহানগর যুবদল নেতা রুবেলের পিতার মাগফিরাত কামনায় দোয়া মাহফিল তিনি ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ ও ত্যাগী রাজনীতিবিদ- খন্দকার মুক্তাদির সিলেটে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে গবেষণা বিষয়ে কর্মশালা তিন শূন্যের পৃথিবী গড়তে দূষণ কমানোর বিকল্প নেই -নূর আজিজুর রহমান

কিছু তার দেখি আভা, কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা- গাজী আব্দুল কাদির মুকুল

গাজী আব্দুল কাদির মুকুল
  • আপডেট সময় : ০৪:৪২:৩৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ৮২ বার পড়া হয়েছে

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ শহীদের প্রচলিত সংখ্যাটি বিশ্বব্যাপী যেভাবে প্রচার পাচ্ছে, তা মনে করিয়ে দেয় জোসেফ গোয়েবলসের সেই তত্ত্ব বা দর্শনের কথা। কথাটি হলো- ‘একটি মিথ্যাকে বারবার বলতে থাকলে একসময় তা সত্য হয়ে যায়’। বলা যায়, তত্ত্বটির বাস্তব নমুনা হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রচলিত ভূয়া, মিথ্যা ও অবিশ্বাস্য কাহিনী। সত্য আবিষ্কার করা একটি বিবেকবান মানুষের মৌলিক দায়িত্ব। একমাত্র মিথ্যাচারীরা সত্য আবিষ্কারের প্রতি উদাসীন হতে পারে। যেকোনো যুদ্ধেই রক্তপাত ঘটে; সুতরাং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও রক্তপাত ঘটেছিল। এ যুদ্ধে শহীদ ও আহত হয়েছেন হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কতজন শহীদ হয়েছেন, সে সংখ্যা এখনো সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। এটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বড় ব্যর্থতা। উন্নত দেশগুলিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখির মৃত্যুর সঠিক হিসাব রাখা হয়; দেশে কতটা পশু সম্পদের ক্ষতি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হয়। তবে এটি নিশ্চিত যে, শত শত বা হাজার বছর পরেও আমাদের দেশের জনগণ এই অসামর্থ্য দেখে বিস্মিত হবে।

একাত্তরের স্বাধীনতার পর থেকে বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ, অথচ এর কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। কারণ গ্রাম-গঞ্জে নিহতদের তালিকা তৈরি করা হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের যে তথ্যটি দেওয়া হয়, তা মাঠ পর্যায়ে কোনো জরিপ বা তথ্য সংগ্রহ ছাড়াই অনুমানের ভিত্তিতে বলা হয়েছে। ফলে, বিবেকবান মানুষের জন্য এই তথ্য বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই অনুমান ভিত্তিক ৩০ লাখ শহীদের তথ্যটি একেবারেই ভূয়া, মিথ্যা এবং অবিশ্বাস্যভাবে অতিরঞ্জিত। সুতরাং, আমাদের জাতীয় ইতিহাসকে ভবিষ্যতে মিথ্যার ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা মোটেই ঠিক নয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে বলে সব পক্ষ থেকেই অভিযোগ উঠেছে এবং উঠছে। তবে সত্য কথা হলো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খুব কম সংখ্যক শিক্ষাবিদ ও ঐতিহাসিক সঠিকভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা করেছেন। নিরপেক্ষ ও আপসহীন তথ্য অনুসন্ধান করে বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস রচনা করে সত্যকে তুলে ধরা বর্তমান সময়ের দাবি।

একাত্তরের যুদ্ধে কতজন শহীদ হয়েছেন, তা গণনা করার সামর্থ্য যে বাংলাদেশ সরকারের ছিল না, বিষয়টি আদৌ তা নয়। কিন্তু অদ্যাবধি কেন তা করা হয়নি, এটাই একটি বড় প্রশ্ন। আজও সঠিক পরিসংখ্যান বের করা কঠিন কোনো কাজ নয়। নিহত আপনজনদের কথা কোনো পরিবার শত বছরেও ভুলবে না; তাই ৫০ বা ৫৫ বছর পর একাত্তরের নিহতের স্মৃতি ভুলে যাওয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। সঠিকভাবে উদ্যোগ নিয়ে জরিপ করলেই শহীদদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব। ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা কেন বলা হচ্ছে, এমনকি একজন শহীদের মৃত্যু বেদনাদায়ক ও অনাকাক্ষিত। কিন্তু গভীর বেদনায় মিথ্যা বলা ন্যায্য নয়। কোনো বেদনাদায়ক ঘটনার সাথে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটালে সেটি বরং কদর্যকর ও নিন্দনীয় হয়। ঘটনা যতই নৃশংস ও বেদনাদায়ক হোক না কেন, নিহতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলা সম্মান বাড়ায় না, বরং মিথ্যাবাদী হিসেবে সবাইকে হেয় করে। দেশের স্বাধীনতার মর্যাদা বাড়াতেও এটি জরুরি নয়।

যাইহোক, ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যার বিভ্রাটের গল্পটি কখন, কোথায় এবং কিভাবে রচিত হয়েছিল তা জানার জন্য নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র রয়েছে। বিবিসি খ্যাত বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব সিরাজুর রহমান তার বিভিন্ন নিবন্ধ ও বইয়ে এই বিষয়ে একাধিকবার আলোচনার সূত্রে তথ্য তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে, ২০১১ সালের মে মাসে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় চিঠিপত্র কলামে প্রকাশিত তার ইংরেজি ভাষায় দেওয়া ব্যাখ্যাটি যথার্থ ও সঠিক বলে আমার বিশ্বাস। এই ব্যাখ্যাটির হুবহু অনুবাদ এখানে তুলে ধরা হলো- “১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি আমিই প্রথম বাংলাদেশী ছিলাম, যিনি পাকিস্তান থেকে মুক্তি পাওয়ার পর স্বাধীনতার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করি। ভারতীয় হাইকমিশনার আপা ভাই পান্থ তাকে হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের ক্লারিজে’স হোটেলে নিয়ে আসেন, এবং আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে পৌঁছে যাই। মি: প্রান্ত মুজিবকে ‘ইওর এক্সিলেন্সি’ বা মহামান্য বলে সম্বোধন করায়, তিনি বিস্মিত ও প্রায় হতবাক হয়েছিলেন। তখন আমি তাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং তার অনুপস্থিতিতে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। স্পষ্টতই, তিনি লন্ডনে পৌঁছেছেন এই ধারণা নিয়ে যে পূর্ব পাকিস্তানিদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে, যার জন্য তিনি আন্দোলন করেছিলেন। সেদিন দিনের বেলায়, আমি ও অন্যান্যরা তাকে যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরলাম। আমি ব্যাখ্যা সহকারে তাকে বলেছিলাম যে হতাহতের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি, তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের অনুমান ছিল যে এই যুদ্ধে তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আমি আশ্চর্য ও আতঙ্কিত হলাম, যখন তিনি পরে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে বলেছিলেন যে, আমার ৩০ লাখ লোক পাকিস্তানিদের দ্বারা নিহত হয়েছে। ৩ ‘লাখ’ কে ‘মিলিয়ন’ হিসাবে ভুল অনুবাদ করেছেন নাকি তার বিভ্রান্তিকর মানসিক অবস্থা দায়ী ছিল তা আমি জানি না, তবে অনেক বাংলাদেশী এখনও বিশ্বাস করেন যে ৩০ লাখের সংখ্যা অবাস্তব এবং অবিশ্বাস্য।”

এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, জনাব সিরাজুর রহমান যে তিন লাখ শহীদের সংখ্যার তথ্যটি আবিষ্কার করেছেন, সেটিও সম্পূর্ণ অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ছিল। যেহেতু তিনি সে সময় দেশে উপস্থিত ছিলেন না, তাই তার কোনো মাঠ পর্যায়ের ধারণাও ছিল না। যুদ্ধকালীন সময়ে প্রচারিত অনেক গুজবের ভিত্তিতে হয়তো কেউ তাকে কোনো বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই ভুল তথ্য সরবরাহ করেছে।

এ ব্যাপারে ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ’ বইয়ে ডা: পিনাকী ভট্টাচার্য আরেকটি তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, “শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য একটি তত্ত্বানুসন্ধান কমিটি গঠন করেন। এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কখনো আলোর মুখ দেখেনি। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এই তদন্ত কমিটি ৫৬,৭৪৩ জনের মৃত্যুর হিসাব করেছিল এবং এই হিসাব পূর্বে ঘোষিত ‘ত্রিশ লাখ’-এর চাইতে অস্বাভাবিক কম হওয়ায় এই রিপোর্টে উল্লিখিত সংখ্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেননি। তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অমীমাংসিত বিষয় হিসেবেই থেকে যায়। ২৮ এপ্রিল ১৯৭৩-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে লেখা একখানি চিঠি দিয়ে বিশেষ দূত হিসেবে এম আর সিদ্দিকীকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব। সেই চিঠিতে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে তিনি গণহত্যায় ‘আমার দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে’ মর্মে উল্লেখ করেন। কিন্তু ‘ত্রিশ লাখ’ হত্যার দাবি করেননি”।

কৌতুহলের বিষয় হলো, শেখ মুজিবের অসতর্কতা বশত: বলে ফেলা একটা ভুল সংখ্যাকে দেববাক্য কিংবা অকাট্য সত্য বলে প্রমাণ করার জন্য আওয়ামীলীগ ও তাদের লেখনী সন্ত্রাসীরা সর্বদা মরিয়া হয়ে আছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, মুজিবকে তারা অতি মানব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, যিনি কোনো ভুলভ্রান্তি করতে পারেন না। তারা জনসাধারণের মধ্যে এ ধারণা গেড়ে দিতে চায় যে, মুজিব যখন যা বলেছেন ও করেছেন, সেটি অভ্রান্ত ও তর্কাতীত মহাসত্য।

প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি বিষয় বলতে হয় যে, যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সেনারা বাঙ্গালীদের উপর অত্যন্ত নির্মম, নৃশংস ও ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছে, যা সন্দেহাতীতভাবে বাস্তব এবং অকাট্যভাবে প্রমাণিত। এই বর্বর আচরণ ও জুলুম পাঞ্জাবি সেনারা যে ভাবে চালিয়েছিল তা চরমসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। সারা বিশ্বের কাছে তখন এটি যুদ্ধ অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতিও লাভ করে। নিষ্ঠুর ও বেদনাদায়ক গণহত্যার বিভিন্ন সঠিক এবং সত্য ঘটনা যখন প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজনরা বর্ণনা করেন, তখন তা শুনলে যে কোন কারো গা শিউরে ওঠে। তবে মজার বিষয় হলো, গণহত্যার ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে এক ধরনের লোক নিজেদের খুশিতে প্রকৃত ঘটনার উপর ইচ্ছামত মিথ্যার রঙ লাগিয়ে বিভিন্ন আজগুবি কাহিনী বানিয়ে বারবার প্রচার করেন। এ সকল অদ্ভুত কাহিনী তারা প্রায়শই হাটে-মাঠে, ঘাটে সর্বত্র প্রচার করেন। এরকম অসংখ্য হাস্যকর ও মিথ্যা কাহিনী থেকে পাঠক সমাজে শুধু একটির কথা উল্লেখ করে আজকের লেখার ইতি টানবো।

উদ্ভট কাহিনীটি জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তার রচিত ‘আত্মজীবনী’ গ্রন্থে এভাবে বর্ণনা করেছেন- “একজন উকিল আমার কাছে বললেন তিনি সিলেটের ভাটিপাড়া থেকে নৌকাযোগে নেত্রকোণা মহকুমার যশমাধব মৌজায় যাওয়া কালে একটা বিশাল হাওর পাড়ি দেওয়ার সময় দেখেছেন সারা হাওর মানুষের লাশে ভর্তি। তাদের নৌকাকে মানুষের লাশের উপর দিয়েই পথ সৃষ্টি করে অগ্রসর হতে হয়েছে। তাতে তার নাকে যে-দুর্গন্ধের প্রবাহ ধেয়ে চলেছিলো তার ফলে এক সপ্তাহ তিনি কোনো কিছুই খেতে পারেন নি। এসব আজগুবি কেচ্ছা-কাহিনী ও অবিশ্বাস্য যেসব রটনা শোনা যেত তার সবকিছু যে অতিরঞ্জিত তাতে বিন্দুমাত্র সংশয়ের স্থান ছিল না, সুতরাং এসবের উপর আমি আস্থা হারিয়েছি”।

লেখক: প্রাবন্ধিক

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

কিছু তার দেখি আভা, কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা- গাজী আব্দুল কাদির মুকুল

আপডেট সময় : ০৪:৪২:৩৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ শহীদের প্রচলিত সংখ্যাটি বিশ্বব্যাপী যেভাবে প্রচার পাচ্ছে, তা মনে করিয়ে দেয় জোসেফ গোয়েবলসের সেই তত্ত্ব বা দর্শনের কথা। কথাটি হলো- ‘একটি মিথ্যাকে বারবার বলতে থাকলে একসময় তা সত্য হয়ে যায়’। বলা যায়, তত্ত্বটির বাস্তব নমুনা হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রচলিত ভূয়া, মিথ্যা ও অবিশ্বাস্য কাহিনী। সত্য আবিষ্কার করা একটি বিবেকবান মানুষের মৌলিক দায়িত্ব। একমাত্র মিথ্যাচারীরা সত্য আবিষ্কারের প্রতি উদাসীন হতে পারে। যেকোনো যুদ্ধেই রক্তপাত ঘটে; সুতরাং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও রক্তপাত ঘটেছিল। এ যুদ্ধে শহীদ ও আহত হয়েছেন হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কতজন শহীদ হয়েছেন, সে সংখ্যা এখনো সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। এটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বড় ব্যর্থতা। উন্নত দেশগুলিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখির মৃত্যুর সঠিক হিসাব রাখা হয়; দেশে কতটা পশু সম্পদের ক্ষতি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হয়। তবে এটি নিশ্চিত যে, শত শত বা হাজার বছর পরেও আমাদের দেশের জনগণ এই অসামর্থ্য দেখে বিস্মিত হবে।

একাত্তরের স্বাধীনতার পর থেকে বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ, অথচ এর কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। কারণ গ্রাম-গঞ্জে নিহতদের তালিকা তৈরি করা হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের যে তথ্যটি দেওয়া হয়, তা মাঠ পর্যায়ে কোনো জরিপ বা তথ্য সংগ্রহ ছাড়াই অনুমানের ভিত্তিতে বলা হয়েছে। ফলে, বিবেকবান মানুষের জন্য এই তথ্য বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই অনুমান ভিত্তিক ৩০ লাখ শহীদের তথ্যটি একেবারেই ভূয়া, মিথ্যা এবং অবিশ্বাস্যভাবে অতিরঞ্জিত। সুতরাং, আমাদের জাতীয় ইতিহাসকে ভবিষ্যতে মিথ্যার ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা মোটেই ঠিক নয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে বলে সব পক্ষ থেকেই অভিযোগ উঠেছে এবং উঠছে। তবে সত্য কথা হলো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খুব কম সংখ্যক শিক্ষাবিদ ও ঐতিহাসিক সঠিকভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা করেছেন। নিরপেক্ষ ও আপসহীন তথ্য অনুসন্ধান করে বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস রচনা করে সত্যকে তুলে ধরা বর্তমান সময়ের দাবি।

একাত্তরের যুদ্ধে কতজন শহীদ হয়েছেন, তা গণনা করার সামর্থ্য যে বাংলাদেশ সরকারের ছিল না, বিষয়টি আদৌ তা নয়। কিন্তু অদ্যাবধি কেন তা করা হয়নি, এটাই একটি বড় প্রশ্ন। আজও সঠিক পরিসংখ্যান বের করা কঠিন কোনো কাজ নয়। নিহত আপনজনদের কথা কোনো পরিবার শত বছরেও ভুলবে না; তাই ৫০ বা ৫৫ বছর পর একাত্তরের নিহতের স্মৃতি ভুলে যাওয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। সঠিকভাবে উদ্যোগ নিয়ে জরিপ করলেই শহীদদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব। ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা কেন বলা হচ্ছে, এমনকি একজন শহীদের মৃত্যু বেদনাদায়ক ও অনাকাক্ষিত। কিন্তু গভীর বেদনায় মিথ্যা বলা ন্যায্য নয়। কোনো বেদনাদায়ক ঘটনার সাথে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটালে সেটি বরং কদর্যকর ও নিন্দনীয় হয়। ঘটনা যতই নৃশংস ও বেদনাদায়ক হোক না কেন, নিহতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলা সম্মান বাড়ায় না, বরং মিথ্যাবাদী হিসেবে সবাইকে হেয় করে। দেশের স্বাধীনতার মর্যাদা বাড়াতেও এটি জরুরি নয়।

যাইহোক, ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যার বিভ্রাটের গল্পটি কখন, কোথায় এবং কিভাবে রচিত হয়েছিল তা জানার জন্য নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র রয়েছে। বিবিসি খ্যাত বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব সিরাজুর রহমান তার বিভিন্ন নিবন্ধ ও বইয়ে এই বিষয়ে একাধিকবার আলোচনার সূত্রে তথ্য তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে, ২০১১ সালের মে মাসে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় চিঠিপত্র কলামে প্রকাশিত তার ইংরেজি ভাষায় দেওয়া ব্যাখ্যাটি যথার্থ ও সঠিক বলে আমার বিশ্বাস। এই ব্যাখ্যাটির হুবহু অনুবাদ এখানে তুলে ধরা হলো- “১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি আমিই প্রথম বাংলাদেশী ছিলাম, যিনি পাকিস্তান থেকে মুক্তি পাওয়ার পর স্বাধীনতার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করি। ভারতীয় হাইকমিশনার আপা ভাই পান্থ তাকে হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের ক্লারিজে’স হোটেলে নিয়ে আসেন, এবং আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে পৌঁছে যাই। মি: প্রান্ত মুজিবকে ‘ইওর এক্সিলেন্সি’ বা মহামান্য বলে সম্বোধন করায়, তিনি বিস্মিত ও প্রায় হতবাক হয়েছিলেন। তখন আমি তাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং তার অনুপস্থিতিতে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। স্পষ্টতই, তিনি লন্ডনে পৌঁছেছেন এই ধারণা নিয়ে যে পূর্ব পাকিস্তানিদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে, যার জন্য তিনি আন্দোলন করেছিলেন। সেদিন দিনের বেলায়, আমি ও অন্যান্যরা তাকে যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরলাম। আমি ব্যাখ্যা সহকারে তাকে বলেছিলাম যে হতাহতের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি, তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের অনুমান ছিল যে এই যুদ্ধে তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আমি আশ্চর্য ও আতঙ্কিত হলাম, যখন তিনি পরে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে বলেছিলেন যে, আমার ৩০ লাখ লোক পাকিস্তানিদের দ্বারা নিহত হয়েছে। ৩ ‘লাখ’ কে ‘মিলিয়ন’ হিসাবে ভুল অনুবাদ করেছেন নাকি তার বিভ্রান্তিকর মানসিক অবস্থা দায়ী ছিল তা আমি জানি না, তবে অনেক বাংলাদেশী এখনও বিশ্বাস করেন যে ৩০ লাখের সংখ্যা অবাস্তব এবং অবিশ্বাস্য।”

এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, জনাব সিরাজুর রহমান যে তিন লাখ শহীদের সংখ্যার তথ্যটি আবিষ্কার করেছেন, সেটিও সম্পূর্ণ অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ছিল। যেহেতু তিনি সে সময় দেশে উপস্থিত ছিলেন না, তাই তার কোনো মাঠ পর্যায়ের ধারণাও ছিল না। যুদ্ধকালীন সময়ে প্রচারিত অনেক গুজবের ভিত্তিতে হয়তো কেউ তাকে কোনো বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই ভুল তথ্য সরবরাহ করেছে।

এ ব্যাপারে ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ’ বইয়ে ডা: পিনাকী ভট্টাচার্য আরেকটি তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, “শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য একটি তত্ত্বানুসন্ধান কমিটি গঠন করেন। এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কখনো আলোর মুখ দেখেনি। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এই তদন্ত কমিটি ৫৬,৭৪৩ জনের মৃত্যুর হিসাব করেছিল এবং এই হিসাব পূর্বে ঘোষিত ‘ত্রিশ লাখ’-এর চাইতে অস্বাভাবিক কম হওয়ায় এই রিপোর্টে উল্লিখিত সংখ্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেননি। তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অমীমাংসিত বিষয় হিসেবেই থেকে যায়। ২৮ এপ্রিল ১৯৭৩-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে লেখা একখানি চিঠি দিয়ে বিশেষ দূত হিসেবে এম আর সিদ্দিকীকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব। সেই চিঠিতে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে তিনি গণহত্যায় ‘আমার দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে’ মর্মে উল্লেখ করেন। কিন্তু ‘ত্রিশ লাখ’ হত্যার দাবি করেননি”।

কৌতুহলের বিষয় হলো, শেখ মুজিবের অসতর্কতা বশত: বলে ফেলা একটা ভুল সংখ্যাকে দেববাক্য কিংবা অকাট্য সত্য বলে প্রমাণ করার জন্য আওয়ামীলীগ ও তাদের লেখনী সন্ত্রাসীরা সর্বদা মরিয়া হয়ে আছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, মুজিবকে তারা অতি মানব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, যিনি কোনো ভুলভ্রান্তি করতে পারেন না। তারা জনসাধারণের মধ্যে এ ধারণা গেড়ে দিতে চায় যে, মুজিব যখন যা বলেছেন ও করেছেন, সেটি অভ্রান্ত ও তর্কাতীত মহাসত্য।

প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি বিষয় বলতে হয় যে, যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সেনারা বাঙ্গালীদের উপর অত্যন্ত নির্মম, নৃশংস ও ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছে, যা সন্দেহাতীতভাবে বাস্তব এবং অকাট্যভাবে প্রমাণিত। এই বর্বর আচরণ ও জুলুম পাঞ্জাবি সেনারা যে ভাবে চালিয়েছিল তা চরমসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। সারা বিশ্বের কাছে তখন এটি যুদ্ধ অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতিও লাভ করে। নিষ্ঠুর ও বেদনাদায়ক গণহত্যার বিভিন্ন সঠিক এবং সত্য ঘটনা যখন প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজনরা বর্ণনা করেন, তখন তা শুনলে যে কোন কারো গা শিউরে ওঠে। তবে মজার বিষয় হলো, গণহত্যার ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে এক ধরনের লোক নিজেদের খুশিতে প্রকৃত ঘটনার উপর ইচ্ছামত মিথ্যার রঙ লাগিয়ে বিভিন্ন আজগুবি কাহিনী বানিয়ে বারবার প্রচার করেন। এ সকল অদ্ভুত কাহিনী তারা প্রায়শই হাটে-মাঠে, ঘাটে সর্বত্র প্রচার করেন। এরকম অসংখ্য হাস্যকর ও মিথ্যা কাহিনী থেকে পাঠক সমাজে শুধু একটির কথা উল্লেখ করে আজকের লেখার ইতি টানবো।

উদ্ভট কাহিনীটি জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তার রচিত ‘আত্মজীবনী’ গ্রন্থে এভাবে বর্ণনা করেছেন- “একজন উকিল আমার কাছে বললেন তিনি সিলেটের ভাটিপাড়া থেকে নৌকাযোগে নেত্রকোণা মহকুমার যশমাধব মৌজায় যাওয়া কালে একটা বিশাল হাওর পাড়ি দেওয়ার সময় দেখেছেন সারা হাওর মানুষের লাশে ভর্তি। তাদের নৌকাকে মানুষের লাশের উপর দিয়েই পথ সৃষ্টি করে অগ্রসর হতে হয়েছে। তাতে তার নাকে যে-দুর্গন্ধের প্রবাহ ধেয়ে চলেছিলো তার ফলে এক সপ্তাহ তিনি কোনো কিছুই খেতে পারেন নি। এসব আজগুবি কেচ্ছা-কাহিনী ও অবিশ্বাস্য যেসব রটনা শোনা যেত তার সবকিছু যে অতিরঞ্জিত তাতে বিন্দুমাত্র সংশয়ের স্থান ছিল না, সুতরাং এসবের উপর আমি আস্থা হারিয়েছি”।

লেখক: প্রাবন্ধিক