ঢাকা ০১:৫৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
এডভোকেট সাইফুল হত্যার প্রধান আসামি চন্দন দাসকে কিশোরগঞ্জ থেকে গ্রেফতার উদয় সমাজ কল্যান সংস্থার ১৮ তম ওয়াজ মাহফিল ৬ ডিসেম্বর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ, সমাবেশের প্রস্তাব আনা হয়েছে: আসিফ নজরুল জাতীয় ঐক্যমত তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক ‘মাহমুদুর রহমান’ নামে দাফন করা লাশটি বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর ! কাফরুলে বাসার গাড়ির ড্রাইভার আটক; স্বর্ণালঙ্কার ও ছয় লক্ষাধিক টাকা উদ্ধার সিলেটের সুনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি মেলা শুরু বায়তুল মোকাররমের খতিবসহ শীর্ষ ১২ আলেমের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা পাচারের ৩২ বছর পর পাকিস্তান থেকে পরিবারের কাছে ফিরছেন পটুয়াখালীর তাসলিমা ! সব ভারতীয় বাংলা চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধে হাইকোর্টে রিট !

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

আওয়ামীলীগ এবং শেখ মুজিবের রাজনীতি- গাজী আব্দুল কাদির মুকুল

গাজী আব্দুল কাদির মুকুল
  • আপডেট সময় : ০১:৫৩:১৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ নভেম্বর ২০২৪ ৮৪ বার পড়া হয়েছে

ব্রিটিশ শাসনামলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ১৯০৬ সালে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিমলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মুসলিমলীগের মাধ্যমে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয়, যা ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে শেষ হয়। তবে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) শোষণের শিকার হতে থাকে।

তৎকালীন মুসলিমলীগ শাসকরা কেন্দ্রের অনুগত ছিলেন, ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তাদের অধিকার আদায় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলিমলীগ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিমলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে দলটি অসাম্প্রদায়ীকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ধারণ করে, ১৯৫৫ সালে দলটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ‘আওয়ামীলীগ’ রাখা হয়। কিছুদিন পর, বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মতভেদের কারণে দলটি বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী দল থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে শেখ মুজিবুর রহমান দলের নেতৃত্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব দলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি ছয় দফা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই ছয়দফা আন্দোলনকে তিনি নিয়মতান্ত্রিক অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে আপামর জনতার সার্বিক গণআন্দোলনে রূপান্তরিত করেন, যার জন্য তিনি সেসময় বাঙালি জনতার অবিসংবাদিত নেতার আসনে আসীন হন। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে সরকার গঠনের যোগ্যতা লাভ করে।তবে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরোধিতার কারণে সেই সরকার গঠন সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ভুট্টো-ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে মিলে একের পর এক ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তারা চায়নি কোনো বাঙালি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোক। তাই তারা নানা ধরনের প্রতারণার খেলা খেলে এবং শেষপর্যন্ত পূর্বপাকিস্তানের জনগণকে অন্ধকার এবং গভীর সংকটের মধ্যে ঠেলে দেয়। দেশে ছড়িয়ে পড়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। এরই মধ্যে,১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।

এই ভাষণের শেষে তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান”। তখন দেশবাসী স্বাধীনতার প্রশ্নে দল-মত নির্বিশেষে শেখ মুজিবকে মেনে নয় একচ্ছত্র নেতা হিসেবে এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে।

যাইহোক, এক উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাক সেনাবাহিনী অস্ত্রসহ ঘুমন্ত ঢাকা নগরবাসীর উপর হামলা চালায় এবং বাঙালিদের উপর শুরু হয় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ। ইতিহাসে এ হত্যাযজ্ঞ বর্বরতা ও নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই হামলার পর অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন চিরতরে নিভে যায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই আকস্মিক আক্রমণের মুখে আওয়ামীলীগসহ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা আত্মরক্ষার্থে যে যে দিকে পারে পালিয়ে যায় বা গা ডাকা দেয়। তবে রহস্যজনকভাবে শেখ মুজিব সেই রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বিনাবাক্য ব্যয়ে আত্মসমর্পণ করে পশ্চিম পা কিস্তানে চলে যান। বিস্ময়-বিমূখ দেশবাসী শেখ মুজিবের সংকটময় মুহূর্তে এই ভিন্ন আচরণে বিভ্রান্ত ও হতবাক হয়ে পড়ে। তাই তার এই আত্মসমর্পণের ফলে গোটাজাতি দিশেহারা হয়ে পড়ে, নেতৃত্বহীন হয়ে যায় এবং জাতি এক ধরনের সংকটে পড়ে। এই সংকটময় মুহূর্তে, মেজর জিয়াউর রহমানের আকস্মিক আবির্ভাব ঘটে। তখন চট্টগ্রামে ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন। তিনি প্রথমে তার বাহিনী নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মেজর জিয়ার বিদ্রোহী কণ্ঠে সাহসী ঘোষণা সেই মুহূর্তে বাঙালি জাতির ধমনীতে
সঞ্চারিত করেছিল এক ঐশ্বরিক শক্তি। তার এই ঘোষণা বাঙলি জাতিকে দৃঢ় প্রত্যয়, আত্মবিশ্বাসএবং আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত করেছিল। যেন সেই মুহূর্তে মেজর জিয়ার আবির্ভাব জাতিকে নিজের সত্তায় স্থিত ও বলীয়ান করতে সাহায্য করে।

উল্লেখ্য, দেশপ্রেমিক মেজর জিয়া হঠাৎ করেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। একটি দেশের একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফসল; বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত, সংঘাত, আত্মত্যাগ এবং আত্মহতির বিনিময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট গড়ে ওঠে, সর্বোপরি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের চরম পরিণতির ফলশ্রুতি।

বলা বাহুল্য, শেখ মুজিবের মাথায় স্বাধীনতার চিন্তা আসার অনেক আগেই মাওলানা ভাসানী এবং অন্যান্য নেতারা এই বিষয়ে কথা বলতে থাকেন এবং জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলেন।

মাওলানা ভাসানীর অনেক বক্তৃতায় স্বাধীনতার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “ওদের সঙ্গে আর একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। ওদের খোদা হাফেজ বলার সময় এসে গেছে। আসসালামু আলাইকুম বলে ওদের বিদায় জানাতে হবে।” তবে এটি অনস্বীকার্য যে, পরবর্তীতে শেখ মুজিব বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, কিন্তু তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। শেখ মুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বও দেননি বা সরাসরি রণাঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন না। তার অনুপস্থিতিতে, দীর্ঘদিন ধরে বাঙালি জাতির হৃদয়ে প্রতীক্ষিত ঐতিহাসিক বাণীটি পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যথাসময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন মেজর জিয়াউর রহমান।

স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামীলীগ ভুল পথে পা দিয়েছিলো। আওয়ামীলীগ একলা মুক্তিযুদ্ধ করেনি। সকল দল ও মতের এবং নির্দলীয় মানুষ ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করেছিলো বলেই স্বাধীনতা এতো তাড়াতাড়ি এসেছিলো। কিন্তু শেখ মুজিব দেশে ফিরে নিজেই ক্ষমতা গ্রহণ করেন। গোড়া থেকেই সর্বময়ক্ষমতা গ্রাস করে নিয়েছিলো আওয়ামীলীগ। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)সহ কেউ কেউ আওয়ামীলীগের একচেটিয়া ক্ষমতা গ্রাসের বিরোধিতা করে। তাদের নিধন করার জন্যে রক্ষী বাহিনী নামে একটা ঘাতক বাহিনী গঠন করা হয়। এরা চল্লিশ হাজার লোককে হত্যা করেছিলো। ভিন্ন চেহারায় হলেও সে প্রক্রিয়া স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের আমলেও চলে ছিল।

শেখ পরিবার বাংলাদেশকে পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করে। বলা চলে তখন ছিল চরম দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি পূর্ণ
দুঃশাসনে ভরপুর একটি দুঃস্বপ্নের কাল।

শেখ মুজিব জাসদকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চেয়েছিলেন, বলেছিলেন:’লাল ঘোড়া দাবাইয়া দিব’। কমরেড সিরাজ শিকদারকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

শেখ মুজিব জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার’। এতোসব করেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ক্ষুধা মেটেনি। পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্যে একদলীয় শাসন পাকাপোক্ত করার জন্যে মধ্য মেয়াদে সংসদের নির্বাচন দেওয়া হয়। সে নির্বাচন ছিলো খুবই বিভাজক। তখন দেশজুড়ে দুর্নীতি ক্রমে ক্রমে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে, এমনকি মুজিবের পরিবারে ও ঢুকে গিয়েছিল। এ সবের ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে ছিলো। তবে দেশে যথেষ্ট খাদ্য মজুদ থাকা সত্বে ও লুটপাট আর কুশাসনের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সত্তর হাজার লোক অনাহারে মারা গিয়েছিলো সে দুর্ভিক্ষে।

সেইসময় কবি রফিক আজাদ রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে কবি তা লিখেছিলেন এভাবে-‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো’। অবশ্য সে জন্য তাহাকে জেলে ও যেতে হয়েছে। সামাজিকভাবে এবং জাতীয় পত্রপত্রিকায় সমালোচনা শুরু হলে মুজিব জরুরী ক্ষমতা আইন পাশ করে হাজার হাজার লোককে কয়েদ করেন এবং চারখানি সরকারী পত্রিকা ছাড়া অন্য সকল পত্র-পত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেন।

একাত্তরে বাংলাদেশের সকল মানুষ জানতো তারা গণতন্ত্রের জন্যে যুদ্ধ করছে, কিন্তু শেখ মুজিব মাওলানা ভাসানীর হাতে জন্ম নেওয়া গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে গড়ে ওঠা আওয়ামীলীগকে নিজ হাতে হত্যা করে গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি চালু করেন, সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন এবং নিজে প্রথম দফায় সাত বছরের জন্যে রাষ্ট্রপতি হন। বাকশাল চালু হবার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা গুলো অনিবার্য্য হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তাই ১৫ আগস্টের রাতে শেখ মুজিব এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নি হত হন। অন্ততঃ সে দিনের ঘটনায় বাংলাদেশে কেউ চোখের পানি ফেলেনি। কেননা, এক অভিশপ্ত ও সর্বনাশা নেতৃত্ব থেকে জনগণ মুক্তি পায় এবং সে দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ে র সূচনা হয়। সেই সময় গোটা দেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ছিল এবং একটি নতুন পথচলা শুরু হয়। আওয়ামীলীগের একদলীয় শাসন এবং শেখ মুজিবের সম্রাট-সুলভ একনায়কত্বের যে রীতি ১৯৭২
সালের জানুয়ারী থেকে চালু হয়েছিলো আওয়ামীলীগ কখনোই সে মনোভাব পরিত্যাগ করতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিল এমন একটি শাসন ব্যবস্থা, যা কুশাসন এবং অপশাসনের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

যে শেখ মুজিব ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সংগ্রামী রাজনীতিবিদ হিসেবে বাঙালির নয়নের মণি এবং জনপ্রিয়তার
উচ্চে অধিষ্ঠিত ছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার সময় বাঙালির চক্ষুশূলে পরিণত হন। এটি তার নিজের বুদ্ধির ভুল, নিজের কাজের ভুল এবং তার দল আওয়ামীলীগের কারণে ঘটেছিল, যার ফলে সমগ্র বাঙালি জনতা তাদের শত্রুতে পরিণত হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ মুজিব চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে ছিলেন। তার প্রশাসনিক যোগ্যতা ছিলনা, বলা চলে; তিনি একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত অযোগ্য। নীতি, আদর্শ এবং দর্শন সবকিছুই তার অপরিণত ও অযৌক্তিক কাজের কারণে ক্ষতিগ্রস্হ হয়েছিল এবং এর ফলে শেখ মুজিব জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেন।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামীলীগ এই ঘটনাগুলোকে কখনো কলঙ্ক বলে মনে করেনি এবং জনগণও তাদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করেনি। তারা তিলকে তাল বানাতে অত্যন্ত দক্ষ।
একটি প্রবাদ আছে: “সব ভালো যার শেষ ভালো তার”। অর্থাৎ যদি কেউ শেষ জীবনে প্রশংসনীয় চরিত্র প্রদর্শন করতে পারে, তবে পূর্ববর্তী সময়ে যত নিন্দনীয় কাজই করেছে, মানুষ তা ভুলে যায় এবং পরবর্তী জীবনের সুখ্যাতি করতে কার্পণ্য করে না। এর বিপরীত উদাহরণও কম নেই। এক সময়ে যাঁর প্রশংসা করা হয়, পরবর্তী জীবনে যদি তিনি নিন্দনীয় চরিত্রের পরিচয় দেন, তবে মানুষ তাঁর পূর্বের প্রশংসা ভুলে যায় এবং শেষ মুহূর্তে নিন্দাবাদ নিয়েই তাকে বিদায় নিতে হয়। বিশ্বজনীন এই নীতি অনুযায়ী শেখ মুজিবের জীবনকে বিবেচনা করলে, স্বীকার করতে হবে যে, ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর জীবন চরম কলঙ্কময়। স্বাধীনতার আগে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকলেও
১৯৭৫ সালের আগস্টে যখন তিনি নিহত হন, তখন মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জনগণের নয়নের মণি ছিলেন; অথচ শেষ পর্যন্ত চরম স্বৈরাচারী, গণতন্ত্র হত্যাকারী, জনগণের সকল অধিকার হরণকারী এবং দুর্নীতির লালনকারী হিসেবে জনগণের ধিক্কার ও অভিশাপ নিয়ে অপমানজনক অবস্থায় পৃথিবী ত্যাগ করেন। এমনকি শেখ মুজিবের অতি ঘনিষ্ঠজনরা ও তাঁর মৃত্যুর পর শোক ও দুঃখ প্রকাশের পরিবর্তে চরম বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আওয়ামীলীগ মহল ছাড়া আর কোথাও শেখ মুজিবের গৌরবময় সময়ের কোন আলোচনা অবশিষ্ট নেই।

সর্বত্র তাঁর জীবনের কলঙ্কময় অধ্যায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো, শেখ মুজিবের নেতিবাচক রাজনৈতিক চরিত্র, যদিও এটি নিদারুণ সত্য, তথাপি আওয়ামী লীগ সহ একশ্রেণীর মেরুদণ্ডহীন নেতা, নীতিহীন বুদ্ধিবুদ্ধিজীবী এবং চরিত্রহীন ব্যক্তি শেখ মুজিবকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নেতা ইত্যাদি বলে গলা ফাটিয়ে উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করেন। এটি বিবেকবান মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে। ভারতের বাঙালিরা এই দাবিকে বিদ্রুপ করে, এমনকি মুখ লুকিয়ে গাধা ও হাসে।

বস্তুত; যার যা প্রাপ্য, তা দিতেই হবে। যদি কেউ এই ক্ষেত্রে
কোনো কার্পণ্য করে, ইতিহাস বাধ্য হয়ে তা সংশোধন করবে এবং সেই কার্পণ্য শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের আস্তা কুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেই। এ কথা অনস্বীকার্য, স্বাধীনতা পূর্ব বাংলা দেশে শেখ মুজিবের অবদান অতুলনীয়। তাঁর অবদানকে অস্বীকার করা মানে ইতিহাস বিকৃত করা। যদি তাঁর অবদানকে কাটছাঁট করা হয়, তাও হবে একটি অন্যায় এবং অবিচার। পাশাপাশি এও আমাদের বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের জনারন্য বা অরন্যের বটবৃক্ষ অন্যান্য নেতাদের মধ্যে শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছাড়া বাঙালি মুসলমানেরা কি শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে পারতো? নজরুলের গান ও কবি তাছাড়া কি তাদের জাগরণ সম্ভব হতো? মওলানা ভাসানীর প্রচেষ্টা ছাড়া কি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারতো? মওলানা ভাসানীর প্রচেষ্টা ছাড়া কি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো? আজকের আওয়ামীলীগ নেতাদের মুখে কি শেরে বাংলা ফজলুল হক, কাজী নজরুল ইসলাম বা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নাম কখনো শোনা যায়? তাদের বাদ দিয়ে আজকের বাংলাদেশ কল্পনা করা পিতা-মাতাহীন একটি সমাজের কল্পনার মতো।

পরিশেষে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, যদি কোনো মতাদর্শের ঊর্ধ্বে থেকে সত্য নিষ্ঠার সাথে এবং সঠিক, সুষ্ঠু
ও নিরপেক্ষভাবে স্বাধীনতা উত্তর আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক ইতিহাস বা চরিত্র পর্যালোচনা করা হয়, তবে স্পষ্ট প্রমাণিত হবে যে আওয়ামীলীগ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সর্বদা একটি অভিশপ্ত ও কলঙ্কিত দল ছিল।

টিকা: এই নিবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের শুধুমাত্র রাজনৈতিক জীবনের সত্য কথা উপস্থাপন করে আলোচনা, পর্যালোচনা বা সমালোচনা করা হয়েছে। তবে তার ব্যক্তিগত জীবনকে অসম্মান বা অপমান করা কোনো ভাবেই কাম্য নয়, তাই তার ব্যক্তিগত জীবন বা চরিত্র নিয়ে আলোচনা থেকে বিরত থাকা হয়েছে।

সর্বোপরি, আমরা জানি শেখ মুজিবুর রহমান একজন মুসলমান ছিলেন, তাই আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যে তিনি তার জীবনের সকল ভুলত্রুটি ক্ষমা করে তাকে জান্নাত দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

আওয়ামীলীগ এবং শেখ মুজিবের রাজনীতি- গাজী আব্দুল কাদির মুকুল

আপডেট সময় : ০১:৫৩:১৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ নভেম্বর ২০২৪

ব্রিটিশ শাসনামলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ১৯০৬ সালে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিমলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মুসলিমলীগের মাধ্যমে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয়, যা ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে শেষ হয়। তবে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) শোষণের শিকার হতে থাকে।

তৎকালীন মুসলিমলীগ শাসকরা কেন্দ্রের অনুগত ছিলেন, ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তাদের অধিকার আদায় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলিমলীগ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিমলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে দলটি অসাম্প্রদায়ীকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ধারণ করে, ১৯৫৫ সালে দলটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ‘আওয়ামীলীগ’ রাখা হয়। কিছুদিন পর, বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মতভেদের কারণে দলটি বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী দল থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে শেখ মুজিবুর রহমান দলের নেতৃত্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব দলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি ছয় দফা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই ছয়দফা আন্দোলনকে তিনি নিয়মতান্ত্রিক অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে আপামর জনতার সার্বিক গণআন্দোলনে রূপান্তরিত করেন, যার জন্য তিনি সেসময় বাঙালি জনতার অবিসংবাদিত নেতার আসনে আসীন হন। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে সরকার গঠনের যোগ্যতা লাভ করে।তবে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরোধিতার কারণে সেই সরকার গঠন সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ভুট্টো-ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে মিলে একের পর এক ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তারা চায়নি কোনো বাঙালি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোক। তাই তারা নানা ধরনের প্রতারণার খেলা খেলে এবং শেষপর্যন্ত পূর্বপাকিস্তানের জনগণকে অন্ধকার এবং গভীর সংকটের মধ্যে ঠেলে দেয়। দেশে ছড়িয়ে পড়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। এরই মধ্যে,১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।

এই ভাষণের শেষে তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান”। তখন দেশবাসী স্বাধীনতার প্রশ্নে দল-মত নির্বিশেষে শেখ মুজিবকে মেনে নয় একচ্ছত্র নেতা হিসেবে এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে।

যাইহোক, এক উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাক সেনাবাহিনী অস্ত্রসহ ঘুমন্ত ঢাকা নগরবাসীর উপর হামলা চালায় এবং বাঙালিদের উপর শুরু হয় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ। ইতিহাসে এ হত্যাযজ্ঞ বর্বরতা ও নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই হামলার পর অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন চিরতরে নিভে যায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই আকস্মিক আক্রমণের মুখে আওয়ামীলীগসহ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা আত্মরক্ষার্থে যে যে দিকে পারে পালিয়ে যায় বা গা ডাকা দেয়। তবে রহস্যজনকভাবে শেখ মুজিব সেই রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বিনাবাক্য ব্যয়ে আত্মসমর্পণ করে পশ্চিম পা কিস্তানে চলে যান। বিস্ময়-বিমূখ দেশবাসী শেখ মুজিবের সংকটময় মুহূর্তে এই ভিন্ন আচরণে বিভ্রান্ত ও হতবাক হয়ে পড়ে। তাই তার এই আত্মসমর্পণের ফলে গোটাজাতি দিশেহারা হয়ে পড়ে, নেতৃত্বহীন হয়ে যায় এবং জাতি এক ধরনের সংকটে পড়ে। এই সংকটময় মুহূর্তে, মেজর জিয়াউর রহমানের আকস্মিক আবির্ভাব ঘটে। তখন চট্টগ্রামে ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন। তিনি প্রথমে তার বাহিনী নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মেজর জিয়ার বিদ্রোহী কণ্ঠে সাহসী ঘোষণা সেই মুহূর্তে বাঙালি জাতির ধমনীতে
সঞ্চারিত করেছিল এক ঐশ্বরিক শক্তি। তার এই ঘোষণা বাঙলি জাতিকে দৃঢ় প্রত্যয়, আত্মবিশ্বাসএবং আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত করেছিল। যেন সেই মুহূর্তে মেজর জিয়ার আবির্ভাব জাতিকে নিজের সত্তায় স্থিত ও বলীয়ান করতে সাহায্য করে।

উল্লেখ্য, দেশপ্রেমিক মেজর জিয়া হঠাৎ করেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। একটি দেশের একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফসল; বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত, সংঘাত, আত্মত্যাগ এবং আত্মহতির বিনিময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট গড়ে ওঠে, সর্বোপরি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের চরম পরিণতির ফলশ্রুতি।

বলা বাহুল্য, শেখ মুজিবের মাথায় স্বাধীনতার চিন্তা আসার অনেক আগেই মাওলানা ভাসানী এবং অন্যান্য নেতারা এই বিষয়ে কথা বলতে থাকেন এবং জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলেন।

মাওলানা ভাসানীর অনেক বক্তৃতায় স্বাধীনতার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “ওদের সঙ্গে আর একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। ওদের খোদা হাফেজ বলার সময় এসে গেছে। আসসালামু আলাইকুম বলে ওদের বিদায় জানাতে হবে।” তবে এটি অনস্বীকার্য যে, পরবর্তীতে শেখ মুজিব বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, কিন্তু তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। শেখ মুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বও দেননি বা সরাসরি রণাঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন না। তার অনুপস্থিতিতে, দীর্ঘদিন ধরে বাঙালি জাতির হৃদয়ে প্রতীক্ষিত ঐতিহাসিক বাণীটি পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যথাসময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন মেজর জিয়াউর রহমান।

স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামীলীগ ভুল পথে পা দিয়েছিলো। আওয়ামীলীগ একলা মুক্তিযুদ্ধ করেনি। সকল দল ও মতের এবং নির্দলীয় মানুষ ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করেছিলো বলেই স্বাধীনতা এতো তাড়াতাড়ি এসেছিলো। কিন্তু শেখ মুজিব দেশে ফিরে নিজেই ক্ষমতা গ্রহণ করেন। গোড়া থেকেই সর্বময়ক্ষমতা গ্রাস করে নিয়েছিলো আওয়ামীলীগ। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)সহ কেউ কেউ আওয়ামীলীগের একচেটিয়া ক্ষমতা গ্রাসের বিরোধিতা করে। তাদের নিধন করার জন্যে রক্ষী বাহিনী নামে একটা ঘাতক বাহিনী গঠন করা হয়। এরা চল্লিশ হাজার লোককে হত্যা করেছিলো। ভিন্ন চেহারায় হলেও সে প্রক্রিয়া স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের আমলেও চলে ছিল।

শেখ পরিবার বাংলাদেশকে পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করে। বলা চলে তখন ছিল চরম দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি পূর্ণ
দুঃশাসনে ভরপুর একটি দুঃস্বপ্নের কাল।

শেখ মুজিব জাসদকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চেয়েছিলেন, বলেছিলেন:’লাল ঘোড়া দাবাইয়া দিব’। কমরেড সিরাজ শিকদারকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

শেখ মুজিব জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার’। এতোসব করেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ক্ষুধা মেটেনি। পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্যে একদলীয় শাসন পাকাপোক্ত করার জন্যে মধ্য মেয়াদে সংসদের নির্বাচন দেওয়া হয়। সে নির্বাচন ছিলো খুবই বিভাজক। তখন দেশজুড়ে দুর্নীতি ক্রমে ক্রমে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে, এমনকি মুজিবের পরিবারে ও ঢুকে গিয়েছিল। এ সবের ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে ছিলো। তবে দেশে যথেষ্ট খাদ্য মজুদ থাকা সত্বে ও লুটপাট আর কুশাসনের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সত্তর হাজার লোক অনাহারে মারা গিয়েছিলো সে দুর্ভিক্ষে।

সেইসময় কবি রফিক আজাদ রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে কবি তা লিখেছিলেন এভাবে-‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো’। অবশ্য সে জন্য তাহাকে জেলে ও যেতে হয়েছে। সামাজিকভাবে এবং জাতীয় পত্রপত্রিকায় সমালোচনা শুরু হলে মুজিব জরুরী ক্ষমতা আইন পাশ করে হাজার হাজার লোককে কয়েদ করেন এবং চারখানি সরকারী পত্রিকা ছাড়া অন্য সকল পত্র-পত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেন।

একাত্তরে বাংলাদেশের সকল মানুষ জানতো তারা গণতন্ত্রের জন্যে যুদ্ধ করছে, কিন্তু শেখ মুজিব মাওলানা ভাসানীর হাতে জন্ম নেওয়া গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে গড়ে ওঠা আওয়ামীলীগকে নিজ হাতে হত্যা করে গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি চালু করেন, সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন এবং নিজে প্রথম দফায় সাত বছরের জন্যে রাষ্ট্রপতি হন। বাকশাল চালু হবার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা গুলো অনিবার্য্য হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তাই ১৫ আগস্টের রাতে শেখ মুজিব এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নি হত হন। অন্ততঃ সে দিনের ঘটনায় বাংলাদেশে কেউ চোখের পানি ফেলেনি। কেননা, এক অভিশপ্ত ও সর্বনাশা নেতৃত্ব থেকে জনগণ মুক্তি পায় এবং সে দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ে র সূচনা হয়। সেই সময় গোটা দেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ছিল এবং একটি নতুন পথচলা শুরু হয়। আওয়ামীলীগের একদলীয় শাসন এবং শেখ মুজিবের সম্রাট-সুলভ একনায়কত্বের যে রীতি ১৯৭২
সালের জানুয়ারী থেকে চালু হয়েছিলো আওয়ামীলীগ কখনোই সে মনোভাব পরিত্যাগ করতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিল এমন একটি শাসন ব্যবস্থা, যা কুশাসন এবং অপশাসনের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

যে শেখ মুজিব ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সংগ্রামী রাজনীতিবিদ হিসেবে বাঙালির নয়নের মণি এবং জনপ্রিয়তার
উচ্চে অধিষ্ঠিত ছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার সময় বাঙালির চক্ষুশূলে পরিণত হন। এটি তার নিজের বুদ্ধির ভুল, নিজের কাজের ভুল এবং তার দল আওয়ামীলীগের কারণে ঘটেছিল, যার ফলে সমগ্র বাঙালি জনতা তাদের শত্রুতে পরিণত হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ মুজিব চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে ছিলেন। তার প্রশাসনিক যোগ্যতা ছিলনা, বলা চলে; তিনি একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত অযোগ্য। নীতি, আদর্শ এবং দর্শন সবকিছুই তার অপরিণত ও অযৌক্তিক কাজের কারণে ক্ষতিগ্রস্হ হয়েছিল এবং এর ফলে শেখ মুজিব জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেন।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামীলীগ এই ঘটনাগুলোকে কখনো কলঙ্ক বলে মনে করেনি এবং জনগণও তাদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করেনি। তারা তিলকে তাল বানাতে অত্যন্ত দক্ষ।
একটি প্রবাদ আছে: “সব ভালো যার শেষ ভালো তার”। অর্থাৎ যদি কেউ শেষ জীবনে প্রশংসনীয় চরিত্র প্রদর্শন করতে পারে, তবে পূর্ববর্তী সময়ে যত নিন্দনীয় কাজই করেছে, মানুষ তা ভুলে যায় এবং পরবর্তী জীবনের সুখ্যাতি করতে কার্পণ্য করে না। এর বিপরীত উদাহরণও কম নেই। এক সময়ে যাঁর প্রশংসা করা হয়, পরবর্তী জীবনে যদি তিনি নিন্দনীয় চরিত্রের পরিচয় দেন, তবে মানুষ তাঁর পূর্বের প্রশংসা ভুলে যায় এবং শেষ মুহূর্তে নিন্দাবাদ নিয়েই তাকে বিদায় নিতে হয়। বিশ্বজনীন এই নীতি অনুযায়ী শেখ মুজিবের জীবনকে বিবেচনা করলে, স্বীকার করতে হবে যে, ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর জীবন চরম কলঙ্কময়। স্বাধীনতার আগে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকলেও
১৯৭৫ সালের আগস্টে যখন তিনি নিহত হন, তখন মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জনগণের নয়নের মণি ছিলেন; অথচ শেষ পর্যন্ত চরম স্বৈরাচারী, গণতন্ত্র হত্যাকারী, জনগণের সকল অধিকার হরণকারী এবং দুর্নীতির লালনকারী হিসেবে জনগণের ধিক্কার ও অভিশাপ নিয়ে অপমানজনক অবস্থায় পৃথিবী ত্যাগ করেন। এমনকি শেখ মুজিবের অতি ঘনিষ্ঠজনরা ও তাঁর মৃত্যুর পর শোক ও দুঃখ প্রকাশের পরিবর্তে চরম বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আওয়ামীলীগ মহল ছাড়া আর কোথাও শেখ মুজিবের গৌরবময় সময়ের কোন আলোচনা অবশিষ্ট নেই।

সর্বত্র তাঁর জীবনের কলঙ্কময় অধ্যায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো, শেখ মুজিবের নেতিবাচক রাজনৈতিক চরিত্র, যদিও এটি নিদারুণ সত্য, তথাপি আওয়ামী লীগ সহ একশ্রেণীর মেরুদণ্ডহীন নেতা, নীতিহীন বুদ্ধিবুদ্ধিজীবী এবং চরিত্রহীন ব্যক্তি শেখ মুজিবকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নেতা ইত্যাদি বলে গলা ফাটিয়ে উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করেন। এটি বিবেকবান মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে। ভারতের বাঙালিরা এই দাবিকে বিদ্রুপ করে, এমনকি মুখ লুকিয়ে গাধা ও হাসে।

বস্তুত; যার যা প্রাপ্য, তা দিতেই হবে। যদি কেউ এই ক্ষেত্রে
কোনো কার্পণ্য করে, ইতিহাস বাধ্য হয়ে তা সংশোধন করবে এবং সেই কার্পণ্য শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের আস্তা কুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেই। এ কথা অনস্বীকার্য, স্বাধীনতা পূর্ব বাংলা দেশে শেখ মুজিবের অবদান অতুলনীয়। তাঁর অবদানকে অস্বীকার করা মানে ইতিহাস বিকৃত করা। যদি তাঁর অবদানকে কাটছাঁট করা হয়, তাও হবে একটি অন্যায় এবং অবিচার। পাশাপাশি এও আমাদের বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের জনারন্য বা অরন্যের বটবৃক্ষ অন্যান্য নেতাদের মধ্যে শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছাড়া বাঙালি মুসলমানেরা কি শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে পারতো? নজরুলের গান ও কবি তাছাড়া কি তাদের জাগরণ সম্ভব হতো? মওলানা ভাসানীর প্রচেষ্টা ছাড়া কি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারতো? মওলানা ভাসানীর প্রচেষ্টা ছাড়া কি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো? আজকের আওয়ামীলীগ নেতাদের মুখে কি শেরে বাংলা ফজলুল হক, কাজী নজরুল ইসলাম বা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নাম কখনো শোনা যায়? তাদের বাদ দিয়ে আজকের বাংলাদেশ কল্পনা করা পিতা-মাতাহীন একটি সমাজের কল্পনার মতো।

পরিশেষে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, যদি কোনো মতাদর্শের ঊর্ধ্বে থেকে সত্য নিষ্ঠার সাথে এবং সঠিক, সুষ্ঠু
ও নিরপেক্ষভাবে স্বাধীনতা উত্তর আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক ইতিহাস বা চরিত্র পর্যালোচনা করা হয়, তবে স্পষ্ট প্রমাণিত হবে যে আওয়ামীলীগ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সর্বদা একটি অভিশপ্ত ও কলঙ্কিত দল ছিল।

টিকা: এই নিবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের শুধুমাত্র রাজনৈতিক জীবনের সত্য কথা উপস্থাপন করে আলোচনা, পর্যালোচনা বা সমালোচনা করা হয়েছে। তবে তার ব্যক্তিগত জীবনকে অসম্মান বা অপমান করা কোনো ভাবেই কাম্য নয়, তাই তার ব্যক্তিগত জীবন বা চরিত্র নিয়ে আলোচনা থেকে বিরত থাকা হয়েছে।

সর্বোপরি, আমরা জানি শেখ মুজিবুর রহমান একজন মুসলমান ছিলেন, তাই আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যে তিনি তার জীবনের সকল ভুলত্রুটি ক্ষমা করে তাকে জান্নাত দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী