ঢাকা ০৪:০৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
সিলেট পারিবারিক সম্পত্তি দখলের অভিযোগ অপপ্রচার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন যুব মহিলালীগ নেত্রী কেকার রহস্যজনক মৃত্যু ! মানববন্ধন কর্মসূচি স্থগিত: আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আশ্বাস সিলেটের কিশোর গ্যাং লিডার বুলেট মামুন সহ ৩ জন গ্রেফতার চামেলীবাগ প্রিমিয়ার লিগ ২০২৫-এর উদ্বোধনী খেলা অনুষ্ঠিত সড়ক উপদেষ্টার সঙ্গে সিলেটের ৩ কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতার বৈঠক শাহপরাণ (রহঃ) থানা পুলিশের অভিযানে কিশোর গ্যাং লিডার কুখ্যাত “বুলেট মামুন” ও তার সহযোগী ০২ (দুই) জন গ্রেফতার বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব পরিষদ-সিলেট অঞ্চল এর উদ্যোগে প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন সিলেটে যানজট নিরসনে টেকসই সমাধান: এনসিপির ২৭ দফা প্রস্তাবনা মজলুমের জবানবন্দি: গাজী আব্দুল কাদির মুকুল

রম্য রচনা

মজলুমের জবানবন্দি: গাজী আব্দুল কাদির মুকুল

গাজী আব্দুল কাদির মুকুল
  • আপডেট সময় : ১০:৪২:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ৬৮ বার পড়া হয়েছে

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। দীর্ঘ নয় মাস ধরে বীর বাঙালিরা রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যায়। হাজার হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং অসংখ্য মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, স্বাধীন বাংলাদেশ, পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয়। এই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাঠকসমাজকে কিছু ভিন্ন স্বাদ এবং বিনোদন দেওয়ার উদ্দেশ্যে এখানে একটি কাল্পনিক গল্প উপস্থাপন করা হলো, যা বাস্তবের সাথে কোন মিল নেই। আশা করি, এটি সবার ভালো লাগবে এবং চিন্তাশীল করে তুলবে।

গল্পের পটভূমি: ধরা যাক, ১৯৭১ সালের নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ লড়াই শেষে দেশের সর্বস্তরের মুক্তিকামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা একসময় ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সংগ্রামের পরও স্বাধীনতা অর্জনের কোনো স্পষ্ট লক্ষণ না দেখে তারা ধীরে ধীরে নিরাশ হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আশাও প্রায় ছেড়ে দেয়। এর ফলস্বরূপ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশেষে সবাই পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এরপর এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা, সংগঠক এবং মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বা আত্মগোপনে চলে যায়। তবে যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি করে রেখেছিল, তাই পরবর্তীতে ব্যর্থ স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ও মূল হোতা হিসেবে তাকেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। সেই বিচার অনুষ্ঠানে মহামান্য বিচারক শেখ মুজিবকে যে সকল প্রশ্ন করেছিলেন এবং শেখ মুজিব তার চিরাচরিত ভঙ্গিতে যেসব উত্তর দিয়েছিলেন, তারই একটি কাল্পনিক বর্ণনা এখানে উপস্থাপন করা হলো।

বিচারক: মিস্টার শেখ মুজিব, আপনি পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভাঙতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন কেন?

শেখ মুজিব: লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ এইডা আমার কান দিয়ে কি শুনলাম, হায় আল্লাহ ! এই দিনটার জন্যই নাকি আমি হীন হায়াতে আছি। এর আগে কেন আমার মউত অইলো না? হুজুর, মাই বাপ; আমার সাধের পাকিস্তান আমি ভাঙবো, তওবা- তওবা- তওবা! সেই বাচপন থেকেই আমি পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েমের জন্য কতনা আন্দোলন-সংগ্রাম, লড়াই, জেল-জুলুম কাইটাছি। আমি ছিলাম একজন মরদে মুজাহিদ, এবং আমার পেয়ারা অখন্ড পাকিস্তান অটুট রাখার জন্য এহনো সংগ্রাম চালাইয়া যাইতেছি। দেহেন, হুজুর, আমি একজন সাচ্চা পাকিস্তানি। পাকিস্তানই আমার জিন্দেগি, পাকিস্তানই আমার বন্দেগি। চাইলে আপনি আমার বুকে কান লাগাইয়া শুনেন, দেখবেন দিনরাত ২৪ ঘন্টা, হরদমে আমার কলব থেকে ইয়া পাকিস্তান! ইয়া পাকিস্তান! বুলন্দ আওয়াজে জিকির হইতাছে। আমি হাকিকি একজন আশিকে পাকিস্তান। আসলে ষড়যন্ত্র করে আমার গায়ে নানা ইনজাম লাগিয়ে আমাকে দোষী বানানো হইছে। দেহেন, জাহাপনা, আমি কিন্তু সত্তরের ইলেকশনে জিইত্তা নিখিল পাকিস্তানের উজিরে আজম হইতে চাইছিলাম। এহনো আমার পুরো উমিদ আছে যে মূলকে পাকিস্তানের আওয়াম আমাকে উজিরে আজম বানাইবে। সেই লক্ষ্যে একটা রফা-দফা বা ফায়সালা হওয়ার জন্য আমার বহুতি পেয়ারা দোস্ত এবং জিগর জুলফিকার আলী ভুট্ট ছাহেব, সহ টিক্কা-ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কতইনা বৈঠক-মুজাকারা ইত্যাদি করতেছিলাম। মাগার আফসোস! এরই মধ্যে ভারতের দালাল, রাজাকার, গাদ্দার এবং দেশদ্রোহী কিছু বাঙ্গালিরা বাংলার মুক্তিযুদ্ধের নামে পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে সাধারণ জনগণকে গুম, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, রাহাজানি সহ দেশটাকে এক ভয়াবহ জাহান্নামি তাণ্ডবে পরিণত করে দিয়েছিল। এবং এদেরকে হিন্দুস্তানের অভিশপ্ত মালাউনরা সাহারা ও মদদ যুগাইছিল। কি কইম? জাহাপনা, আমি অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী, এবং এই অখন্ড পাকিস্তান দায়েম-কায়েম রাখার জন্য আমার জিন্দেগি কুরবান করে দিতে হার ওয়াক্ত তৈয়ার। আমাকে নিয়ে মিছা অভিযোগ দায়ের করা অইছে; আসলে আমার উপর জুলুম অইতাছে। আমি একজন মুজরিম; আমার বিরুদ্ধে যত সিকায়ত রয়েছে, এইসব নেহায়ত ঝুট। আমার কোন কছুরি নেই, বিলকুল মাসুম। আমি আমার আজাদীর জন্য আপনার কাছে হাত জোড় করে ইনসাফ এবং মদদ দরখাস্ত করতাছি।

বিচারক: তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটি কে দিল?

শেখ মুজিব: ঐই যে কুখ্যাত, অখ্যাত, এক মেজর, ব্যাটার নামটা কি জানি; হ্যাঁ, মনে অইতাছে- জিয়াউর রহমান! এই রাষ্ট্রদ্রোহী কুলাঙ্গারই, আমাদের চির দুশমন ভারতের মদদে, বেইমানি করে, রাষ্ট্রের সঙ্গে বিদ্রোহ করে, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের আমাদের দেশ প্রেমিক বহুৎ ফৌজিকে শহীদ করে, আমার পিয়ারা পাকিস্তানকে দু টুকরো করে ভাঙ্গনের লাইগা হেডায়ই স্বাধীনতা ঘোষণা দিছে। মুহতারাম জাহাপনা! আমাকে আজাদ কইরা দেন, দেখবেন আমি এই কুলাঙ্গার সহ, মুক্তিযুদ্ধের নামে আরো যত রাষ্ট্রদ্রোহী দুশমন আছে, তাদের গুষ্টি-শুদ্ধা সবাইকে তালাশ করে বের করবো এবং পাকড়াও করে আহনের পবিত্র কদমে হাজির করাবো। কারণ, এরা কে কোথায় ? এ সম্পর্কে আমার বেহতরিন ইলিম আছে, এবং বিশেষ করে বাঙ্গালীদের মগজের পালস ভালোভাবে আমি জানি। দীর্ঘদিন ধরে আমি ওদেরকে চালিয়ে আইতাছি; ওদের ব্যাপারে আমার সহীহ ছমঝ-বুঝ রয়েছে। আমি সেই সকল বেওকুফদেরকে আপনার হাওলা করার পর, আপনি এই মহামান্য আদালতে সকল দুশমনদের ফাঁসির আদেশ দিয়ে তা কার্যকর করাবেন; বিশেষ করে জিয়াউর রহমান নামের সেই ভারতের চর, রাজাকার এবং দালাল কুলাঙ্গারটিকে সর্বোচ্চ কঠিন শাস্তি দিবেন।

বিচারক: মিস্টার মুজিব, আপনাকে কি কেউ কখনও স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য কোন ধরনের প্ররোচনা দিয়েছিল?

শেখ মুজিব: জি, হ্যাঁ, মুহতারাম জাহাপনা! আমি গ্রেফতার হওনের আগে, আমার দলের কিছু হিন্দুস্তানি দালাল এবং বিশ্বাসঘাতক যেমন তাজুদ্দি ও সিরাজুল আলম খাঁ, এরা আমাকে কইছিল লিডার! আপনি বাংলাদেশের আজাদী এলান করে দিন। আমি সাথে সাথে বলে উঠলাম ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ এবং এও কইলাম, খবরদার! কও কি? জবান সামলিয়ে কথা কও; হাতের নাগালে তলোয়ার পেলে তোদের আমি কাতল করে দিতাম। দুসরী, আর কোন কালাম করিও না; তোমাদের মাথা খারাপ হইয়া গেছে, আমার সামন থেকে চলে যাও। তোরা দেশের দুশমন, জাতির দুশমন, পেয়ারা পাকিস্তানকে দু টুকরো করে ভাঙ্গনের লাইগা ষড়যন্ত্র করতেছো। জানো, এটা রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ। তোরা সবাই তওবা কর এবং অখন্ড পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ় আনুগত্য কর। এছাড়া, জিন্দেগী ভর হিম্মতের সহিত নিখিল পাকিস্তানকে আবাদ রাখনের লাইগা কৌশিশ জারি রাখো; নইলে আমি তোদের কানুনের হাওলা করব।

বিচারক: মিস্টার মুজিব, পূর্ব পাকিস্তানের কিছু সংখ্যক তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধারা আপনাকে পাকিস্তানের চর, স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকার এবং আল-বদর ইত্যাদি শব্দ দ্বারা প্রতিনিয়ত গালাগালিতে লিপ্ত। এদের সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা কী?

শেখ মুজিব: দেহেন জাহাপনা, এদের ব্যাপারে আমার ইরাদা হলো- যেই মুহূর্তে আমি হাজত থেকে রুখসাত পাব, সাথে সাথে ঐ সকল খবিস এবং ভারতের দালাল, গাদ্দার ও পাগলদের তালাশ করে বের করে এক জায়গায় একাট্টা করব, এবং এদের সেই অদ্ভুত ধরনের বিমারি দিমাগের এক জবরদস্ত এলাজ করব। এলাজের তরিকাটি হল: একটি কাগজে রাজাকার, আল-বদর, স্বাধীনতা বিরোধী ইত্যাদি শব্দগুলো লিখে, পানিভর্তি একটি বড় গামলাতে রেখে ঝাড়-ফোক করে এতে দম দেব, এবং সবকটি পাগলকে তা এক এক গ্লাস করে একদমে গিলাব। এরপর, এদেরকে কড়া হলুদ রঙ্গের সিলাইবিহীন লুঙ্গি ও গায়ে একটি চাদর পরিয়ে, ত্রিমুখী সড়কের এক পাশে ঋষিদের মত মাটিতে পা জোড় করে বসিয়ে এবং দু হাটুতে দুই হাত রেখে বলবো- এখন থেকে চোখ-মুখ বন্ধ করে তোমরা মউত ত্বক সুবে-সাম রাজাকার, আল-বদর, স্বাধীনতা বিরোধী এই সকল মন্ত্র জপতে থাকো। আর, আমরা আমাদের জানে জিগার, পেয়ারা পাকিস্তানকে জিন্দেগি ভর মহব্বত করে যাব, এবং এর খুবসুরত ভবিষ্যতের জন্য হার কিসিমের মেহনত-মশক্কত চালিয়ে যাব।

বিচারক: আদালত সকল প্রমাণ, ব্যাখ্যা ও পক্ষসমূহের বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে-শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ মিথ্যা। অতএব, তাকে অতি সত্বর মুক্তি দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদত্ত হোক। সঙ্গে, আদালত মিস্টার মুজিবকে উপদেশ প্রদান করছে যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের সুন্দর ও স্থিতিশীল ভবিষ্যত গঠনে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাবেন; যাতে ইতিহাসে বাঙালি জাতি তাকে অখ্যাত কিংবা কলঙ্কিত একজন ব্যক্তি হিসেবে না মনে করে। অতঃপর, আদালত তাকে সতর্কও করছে যে- পেশ ও রাজনৈতিক কাজে তিনি কখনোই কোনো প্ররোচনামূলক প্রভাবের অনুগামী হবেন না; বিশেষত পড়শি হিন্দুস্তানের শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রদত্ত কমলালেবু দেখানোর কোনো প্ররোচনার প্রতি সদা সাবধান থাকবেন।

শেখ মুজিব: হুজুর মাই বাপ! আপনার বহুৎ মেহেরবানী, লক্ষ-কোটি শুকুর-গুজার। আর হ্যাঁ, আমি আপনার সামনে মজবুত ওয়াদা কইরা যাইতাছি যে- আগামীতে সুযোগ পেলে ‘বাকশাল’ কায়েমের মাধ্যমে বাংলা এবং বাঙ্গালীদের এমন একটি নাটকীয় ও স্থায়ী পরিবর্তন ঘটাইয়া দেখাইবো, যে তারা তাদের কলব থেকে আমাকে কেয়ামত তক বুলন্দ আওয়াজে ইয়াদ রাখবে। আমি সিরফ ইহা কথার কথা কইতাছি না; আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে আমার শাসন, নীতি ও কর্মশৈলীর মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে বিচারা বাঙ্গালীদের বারোটা বাজিয়ে তা বাস্তবায়ন করবোই করবো।

লেখক: প্রাবন্ধিক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী

 

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

রম্য রচনা

মজলুমের জবানবন্দি: গাজী আব্দুল কাদির মুকুল

আপডেট সময় : ১০:৪২:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। দীর্ঘ নয় মাস ধরে বীর বাঙালিরা রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যায়। হাজার হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং অসংখ্য মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, স্বাধীন বাংলাদেশ, পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয়। এই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাঠকসমাজকে কিছু ভিন্ন স্বাদ এবং বিনোদন দেওয়ার উদ্দেশ্যে এখানে একটি কাল্পনিক গল্প উপস্থাপন করা হলো, যা বাস্তবের সাথে কোন মিল নেই। আশা করি, এটি সবার ভালো লাগবে এবং চিন্তাশীল করে তুলবে।

গল্পের পটভূমি: ধরা যাক, ১৯৭১ সালের নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ লড়াই শেষে দেশের সর্বস্তরের মুক্তিকামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা একসময় ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সংগ্রামের পরও স্বাধীনতা অর্জনের কোনো স্পষ্ট লক্ষণ না দেখে তারা ধীরে ধীরে নিরাশ হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আশাও প্রায় ছেড়ে দেয়। এর ফলস্বরূপ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশেষে সবাই পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এরপর এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা, সংগঠক এবং মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বা আত্মগোপনে চলে যায়। তবে যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি করে রেখেছিল, তাই পরবর্তীতে ব্যর্থ স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ও মূল হোতা হিসেবে তাকেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। সেই বিচার অনুষ্ঠানে মহামান্য বিচারক শেখ মুজিবকে যে সকল প্রশ্ন করেছিলেন এবং শেখ মুজিব তার চিরাচরিত ভঙ্গিতে যেসব উত্তর দিয়েছিলেন, তারই একটি কাল্পনিক বর্ণনা এখানে উপস্থাপন করা হলো।

বিচারক: মিস্টার শেখ মুজিব, আপনি পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভাঙতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন কেন?

শেখ মুজিব: লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ এইডা আমার কান দিয়ে কি শুনলাম, হায় আল্লাহ ! এই দিনটার জন্যই নাকি আমি হীন হায়াতে আছি। এর আগে কেন আমার মউত অইলো না? হুজুর, মাই বাপ; আমার সাধের পাকিস্তান আমি ভাঙবো, তওবা- তওবা- তওবা! সেই বাচপন থেকেই আমি পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েমের জন্য কতনা আন্দোলন-সংগ্রাম, লড়াই, জেল-জুলুম কাইটাছি। আমি ছিলাম একজন মরদে মুজাহিদ, এবং আমার পেয়ারা অখন্ড পাকিস্তান অটুট রাখার জন্য এহনো সংগ্রাম চালাইয়া যাইতেছি। দেহেন, হুজুর, আমি একজন সাচ্চা পাকিস্তানি। পাকিস্তানই আমার জিন্দেগি, পাকিস্তানই আমার বন্দেগি। চাইলে আপনি আমার বুকে কান লাগাইয়া শুনেন, দেখবেন দিনরাত ২৪ ঘন্টা, হরদমে আমার কলব থেকে ইয়া পাকিস্তান! ইয়া পাকিস্তান! বুলন্দ আওয়াজে জিকির হইতাছে। আমি হাকিকি একজন আশিকে পাকিস্তান। আসলে ষড়যন্ত্র করে আমার গায়ে নানা ইনজাম লাগিয়ে আমাকে দোষী বানানো হইছে। দেহেন, জাহাপনা, আমি কিন্তু সত্তরের ইলেকশনে জিইত্তা নিখিল পাকিস্তানের উজিরে আজম হইতে চাইছিলাম। এহনো আমার পুরো উমিদ আছে যে মূলকে পাকিস্তানের আওয়াম আমাকে উজিরে আজম বানাইবে। সেই লক্ষ্যে একটা রফা-দফা বা ফায়সালা হওয়ার জন্য আমার বহুতি পেয়ারা দোস্ত এবং জিগর জুলফিকার আলী ভুট্ট ছাহেব, সহ টিক্কা-ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কতইনা বৈঠক-মুজাকারা ইত্যাদি করতেছিলাম। মাগার আফসোস! এরই মধ্যে ভারতের দালাল, রাজাকার, গাদ্দার এবং দেশদ্রোহী কিছু বাঙ্গালিরা বাংলার মুক্তিযুদ্ধের নামে পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে সাধারণ জনগণকে গুম, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, রাহাজানি সহ দেশটাকে এক ভয়াবহ জাহান্নামি তাণ্ডবে পরিণত করে দিয়েছিল। এবং এদেরকে হিন্দুস্তানের অভিশপ্ত মালাউনরা সাহারা ও মদদ যুগাইছিল। কি কইম? জাহাপনা, আমি অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী, এবং এই অখন্ড পাকিস্তান দায়েম-কায়েম রাখার জন্য আমার জিন্দেগি কুরবান করে দিতে হার ওয়াক্ত তৈয়ার। আমাকে নিয়ে মিছা অভিযোগ দায়ের করা অইছে; আসলে আমার উপর জুলুম অইতাছে। আমি একজন মুজরিম; আমার বিরুদ্ধে যত সিকায়ত রয়েছে, এইসব নেহায়ত ঝুট। আমার কোন কছুরি নেই, বিলকুল মাসুম। আমি আমার আজাদীর জন্য আপনার কাছে হাত জোড় করে ইনসাফ এবং মদদ দরখাস্ত করতাছি।

বিচারক: তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটি কে দিল?

শেখ মুজিব: ঐই যে কুখ্যাত, অখ্যাত, এক মেজর, ব্যাটার নামটা কি জানি; হ্যাঁ, মনে অইতাছে- জিয়াউর রহমান! এই রাষ্ট্রদ্রোহী কুলাঙ্গারই, আমাদের চির দুশমন ভারতের মদদে, বেইমানি করে, রাষ্ট্রের সঙ্গে বিদ্রোহ করে, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের আমাদের দেশ প্রেমিক বহুৎ ফৌজিকে শহীদ করে, আমার পিয়ারা পাকিস্তানকে দু টুকরো করে ভাঙ্গনের লাইগা হেডায়ই স্বাধীনতা ঘোষণা দিছে। মুহতারাম জাহাপনা! আমাকে আজাদ কইরা দেন, দেখবেন আমি এই কুলাঙ্গার সহ, মুক্তিযুদ্ধের নামে আরো যত রাষ্ট্রদ্রোহী দুশমন আছে, তাদের গুষ্টি-শুদ্ধা সবাইকে তালাশ করে বের করবো এবং পাকড়াও করে আহনের পবিত্র কদমে হাজির করাবো। কারণ, এরা কে কোথায় ? এ সম্পর্কে আমার বেহতরিন ইলিম আছে, এবং বিশেষ করে বাঙ্গালীদের মগজের পালস ভালোভাবে আমি জানি। দীর্ঘদিন ধরে আমি ওদেরকে চালিয়ে আইতাছি; ওদের ব্যাপারে আমার সহীহ ছমঝ-বুঝ রয়েছে। আমি সেই সকল বেওকুফদেরকে আপনার হাওলা করার পর, আপনি এই মহামান্য আদালতে সকল দুশমনদের ফাঁসির আদেশ দিয়ে তা কার্যকর করাবেন; বিশেষ করে জিয়াউর রহমান নামের সেই ভারতের চর, রাজাকার এবং দালাল কুলাঙ্গারটিকে সর্বোচ্চ কঠিন শাস্তি দিবেন।

বিচারক: মিস্টার মুজিব, আপনাকে কি কেউ কখনও স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য কোন ধরনের প্ররোচনা দিয়েছিল?

শেখ মুজিব: জি, হ্যাঁ, মুহতারাম জাহাপনা! আমি গ্রেফতার হওনের আগে, আমার দলের কিছু হিন্দুস্তানি দালাল এবং বিশ্বাসঘাতক যেমন তাজুদ্দি ও সিরাজুল আলম খাঁ, এরা আমাকে কইছিল লিডার! আপনি বাংলাদেশের আজাদী এলান করে দিন। আমি সাথে সাথে বলে উঠলাম ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ এবং এও কইলাম, খবরদার! কও কি? জবান সামলিয়ে কথা কও; হাতের নাগালে তলোয়ার পেলে তোদের আমি কাতল করে দিতাম। দুসরী, আর কোন কালাম করিও না; তোমাদের মাথা খারাপ হইয়া গেছে, আমার সামন থেকে চলে যাও। তোরা দেশের দুশমন, জাতির দুশমন, পেয়ারা পাকিস্তানকে দু টুকরো করে ভাঙ্গনের লাইগা ষড়যন্ত্র করতেছো। জানো, এটা রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ। তোরা সবাই তওবা কর এবং অখন্ড পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ় আনুগত্য কর। এছাড়া, জিন্দেগী ভর হিম্মতের সহিত নিখিল পাকিস্তানকে আবাদ রাখনের লাইগা কৌশিশ জারি রাখো; নইলে আমি তোদের কানুনের হাওলা করব।

বিচারক: মিস্টার মুজিব, পূর্ব পাকিস্তানের কিছু সংখ্যক তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধারা আপনাকে পাকিস্তানের চর, স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকার এবং আল-বদর ইত্যাদি শব্দ দ্বারা প্রতিনিয়ত গালাগালিতে লিপ্ত। এদের সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা কী?

শেখ মুজিব: দেহেন জাহাপনা, এদের ব্যাপারে আমার ইরাদা হলো- যেই মুহূর্তে আমি হাজত থেকে রুখসাত পাব, সাথে সাথে ঐ সকল খবিস এবং ভারতের দালাল, গাদ্দার ও পাগলদের তালাশ করে বের করে এক জায়গায় একাট্টা করব, এবং এদের সেই অদ্ভুত ধরনের বিমারি দিমাগের এক জবরদস্ত এলাজ করব। এলাজের তরিকাটি হল: একটি কাগজে রাজাকার, আল-বদর, স্বাধীনতা বিরোধী ইত্যাদি শব্দগুলো লিখে, পানিভর্তি একটি বড় গামলাতে রেখে ঝাড়-ফোক করে এতে দম দেব, এবং সবকটি পাগলকে তা এক এক গ্লাস করে একদমে গিলাব। এরপর, এদেরকে কড়া হলুদ রঙ্গের সিলাইবিহীন লুঙ্গি ও গায়ে একটি চাদর পরিয়ে, ত্রিমুখী সড়কের এক পাশে ঋষিদের মত মাটিতে পা জোড় করে বসিয়ে এবং দু হাটুতে দুই হাত রেখে বলবো- এখন থেকে চোখ-মুখ বন্ধ করে তোমরা মউত ত্বক সুবে-সাম রাজাকার, আল-বদর, স্বাধীনতা বিরোধী এই সকল মন্ত্র জপতে থাকো। আর, আমরা আমাদের জানে জিগার, পেয়ারা পাকিস্তানকে জিন্দেগি ভর মহব্বত করে যাব, এবং এর খুবসুরত ভবিষ্যতের জন্য হার কিসিমের মেহনত-মশক্কত চালিয়ে যাব।

বিচারক: আদালত সকল প্রমাণ, ব্যাখ্যা ও পক্ষসমূহের বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে-শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ মিথ্যা। অতএব, তাকে অতি সত্বর মুক্তি দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদত্ত হোক। সঙ্গে, আদালত মিস্টার মুজিবকে উপদেশ প্রদান করছে যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের সুন্দর ও স্থিতিশীল ভবিষ্যত গঠনে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাবেন; যাতে ইতিহাসে বাঙালি জাতি তাকে অখ্যাত কিংবা কলঙ্কিত একজন ব্যক্তি হিসেবে না মনে করে। অতঃপর, আদালত তাকে সতর্কও করছে যে- পেশ ও রাজনৈতিক কাজে তিনি কখনোই কোনো প্ররোচনামূলক প্রভাবের অনুগামী হবেন না; বিশেষত পড়শি হিন্দুস্তানের শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রদত্ত কমলালেবু দেখানোর কোনো প্ররোচনার প্রতি সদা সাবধান থাকবেন।

শেখ মুজিব: হুজুর মাই বাপ! আপনার বহুৎ মেহেরবানী, লক্ষ-কোটি শুকুর-গুজার। আর হ্যাঁ, আমি আপনার সামনে মজবুত ওয়াদা কইরা যাইতাছি যে- আগামীতে সুযোগ পেলে ‘বাকশাল’ কায়েমের মাধ্যমে বাংলা এবং বাঙ্গালীদের এমন একটি নাটকীয় ও স্থায়ী পরিবর্তন ঘটাইয়া দেখাইবো, যে তারা তাদের কলব থেকে আমাকে কেয়ামত তক বুলন্দ আওয়াজে ইয়াদ রাখবে। আমি সিরফ ইহা কথার কথা কইতাছি না; আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে আমার শাসন, নীতি ও কর্মশৈলীর মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে বিচারা বাঙ্গালীদের বারোটা বাজিয়ে তা বাস্তবায়ন করবোই করবো।

লেখক: প্রাবন্ধিক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী